অস্ত্রের লাইসেন্স চান ছাত্রলীগ নেতা রিয়াদ
![অস্ত্রের লাইসেন্স চান ছাত্রলীগ নেতা রিয়াদ অস্ত্রের লাইসেন্স চান ছাত্রলীগ নেতা রিয়াদ](https://www.pressnarayanganj24.com/media/imgAll/2024February/riad-2402121616.jpg)
নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ। তাঁর বিরুদ্ধে জেলার অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি তোলারাম কলেজের একাধিক ছাত্র, সাংবাদিক ও ছাত্রনেতাদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। তোলারাম কলেজে দীর্ঘ বছর ছাত্রছাত্রী সংসদের নির্বাচন না হলেও নিজেকে কলেজের ভিপি (ছাত্রছাত্রী সংসদের সহসভাপতি) পরিচয় দিয়ে বেড়ান রিয়াদ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে টর্চারসেল চালান বলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও নাগরিক সভা-সমাবেশে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে। ইউপি নির্বাচন চলাকালীন দলবল নিয়ে কেন্দ্র দখল করতে গিয়ে র্যাব সদস্যদের পিটুনির শিকার ছাত্রলীগের এই নেতা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবেদন করেছেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের জানুয়ারি মাসে নিজেকে ব্যবসায়ী দাবি করে একটি শটগানের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন হাবিবুর রহমান রিয়াদ। অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদনে হাবিবুর রহমান রিয়াদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘জালাল এন্টারপ্রাইজ’ দেখানো হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এটি একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
নিয়ম অনুযায়ী আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের বিষয়ে চিঠি যায় জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে। গত সেপ্টেম্বরে এই ছাত্রলীগের নেতার আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদনের বিপরীতে অনাপত্তি দেয় জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়। বর্তমানে আবেদনটি জেলা প্রশাসক তথা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
এদিকে, সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতাকে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হলে তিনি এর অপব্যবহার করবেন বলে শঙ্কা প্রকাশ করে তাকে লাইসেন্স না প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন সুশীল সমাজের নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ১৫ জুলাই রাতে সরকারি তোলারাম কলেজের সামনের সড়ক দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ছাত্রদলের ৪ নেতা-কর্মীকে বেধড়ক পেটায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মারধরের এই ঘটনায় ছাত্রলীগকে নেতৃত্ব দেন হাবিবুর রহমান রিয়াদ। ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে গেলে ছবি ও ভিডিও ধারণে বাধা দিয়ে দুই সাংবাদিককে মারধর করেন তারা। তাদের মুঠোফোনও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। পরে পুলিশের উপস্থিতিতে সাংবাদিক তার মোবাইল ফেরত পান।
২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সরকারি তোলারাম কলেজে ফরম পূরণ করতে গিয়ে হাবিবুর রহমান রিয়াদ ও তার লোকজনের মারধরের শিকার হন আতা-ই-রাব্বি ও আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির স্নাতকের দুই শিক্ষার্থী। তারা দু’জন যথাক্রমে ওই কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়ক পদে ছিলেন।
২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একইভাবে ফরম ফিলাপের জন্য গেলে নিজ বিভাগের সামনে মারধরের শিকার হন স্নাতক তৃতীয় বর্ষের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের ছাত্র সৌরভ হোসেন সিয়াম। সাংবাদিকতার সাথে জড়িত এই শিক্ষার্থীকে তোলারাম কলেজের ভেতরে একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল বেধরক মারধর করেন হাবিবুর রহমান রিয়াদ। কলেজের ওই কক্ষটিকে রিয়াদ নিজের টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীকে সেখানে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে কলেজের সামনের সড়কে শাহজাহান আলী নামে আরেক ছাত্রকে বেধরক পেটায় তোলারাম কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ওই হামলায়ও নেতৃত্ব দেন হাবিবুর রহমান রিয়াদ।
সাধারণ ছাত্র, ছাত্রনেতা ও সাংবাদিকদের পিটিয়েই কেবল আলোচিত নন মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক এই সভাপতি। ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর সদর উপজেলার এনায়েতনগর ইউপির একটি ভোটকেন্দ্র দখলে গিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হন হাবিবুর রহমান রিয়াদ। ভোটকেন্দ্রের সামনে বিশৃঙ্খলা করা রিয়াদ ও তার দলবলকে লাঠিপেটাও করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন। পরে তাদের কাছ থেকে ককটেল, ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোটাও উদ্ধার করে র্যাব।
এই ঘটনায় কিছুক্ষণ পর ওই কেন্দ্রে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান যান। তখন রিয়াদ র্যাব সদস্যদের দেখিয়ে শামীম ওসমানের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের কুত্তার (কুকুর) মতো পিটিয়েছে।’
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হাবিবুর রহমান রিয়াদ নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমান ওরফে অয়ন ওসমানের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হলেও ছাত্রলীগের একটি অংশকে এখনও নেতৃত্ব দেন রিয়াদ। গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে শহরের চাষাঢ়ায় আল-আমিন ওরফে দানিয়েল নামে ২৮ বছর বয়সী এক যুবককে কুপিয়ে লাশ ফেলা হয় মাসদাইরে তার বাড়ির সামনে। এই হত্যাকান্ডে জড়িতরাও হাবিবুর রহমান রিয়াদের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত। এই হত্যা মামলার প্রধান আসামি অনিক প্রধান সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রিয়াদের আত্মীয়।
প্রতিটি ঘটনায় স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে রিয়াদের নাম আসলেও প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকার কারণে রিয়াদের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়ার সাহস কেউ করেন না। তবে, সাংবাদিক সৌরভ হোসেন সিয়াম তার উপর নির্যাতনের ঘটনায় হাবিবুর রহমান রিয়াদ ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন।
অপরাধমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থাকা ব্যক্তিকে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান করা হলে তা ভালো কাজে ব্যবহৃত হবে না বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল।
তিনি বলেন, ‘সারাদেশে কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের ছাত্র সংগঠন নানা ধরনের অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সারাদেশেই এমন ঘটনার খবর পাচ্ছি। তাদের এই অপকর্মের জন্য তো লাইসেন্সের প্রয়োজন আছে তাই তারা বেশি শক্তিতে বলিয়ান হতে অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে। এইটা আমাদের দুর্ভাগ্য।’
‘একজন ছাত্রনেতার তো লাইসেন্সের প্রয়োজন থাকতে পারে না। লাইসেন্স পেলে এই অস্ত্র তারা কী কাজে ব্যবহার করবেন তাও দেশের মানুষ জানে। ফলে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে প্রশাসনের লোকজনকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাই। এইভাবে অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকা লোকজন আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়ে গেলে সমাজে আর সুশাসন থাকবে না।’
এই ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ‘নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে যে কেউ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু ক্রাইটেরিয়া থাকে। সেসব বিষয় ঠিক থাকলে আবেদনকারী অস্ত্রের লাইসেন্স পান, নাহলে পান না। সব আদেনকারীর ক্ষেত্রেই একইরকম সিস্টেম।’