২৭ জুলাই ২০২৪

সৌরভ হোসেন সিয়াম

প্রকাশিত: ১৯:৪৬, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

শীতলক্ষ্যা পাড়ের দশক পুরানো ৮১ গাছ কাটছে বিআইডব্লিউটিএ

শীতলক্ষ্যা পাড়ের দশক পুরানো ৮১ গাছ কাটছে বিআইডব্লিউটিএ

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ একটি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নারায়ণগঞ্জ শহরের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে কয়েক ডজন পরিণত গাছ কেটে ফেলেছে। তবে, নির্বিচারে গাছ কাটার এই কার্যক্রমকে ‘গণহত্যার’ সাথে তুলনা করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীরা। পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় বিআইডব্লিউটিএ’র পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনার আহ্বান জানান তারা।

বিআইডব্লিউটিএ’র নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ওই স্থানে একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যেখানে থাকবে আধুনিক রেস্ট হাউস, পার্কিং প্লেস ইত্যাদি। গত বছরের নভেম্বরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারায়ণগঞ্জে তিনটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিন প্রকল্পের মধ্যে একটি এটি। এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজের জন্য ৮১ টি গাছ কাটা হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জ শহরের ৩ নম্বর মাছঘাট এলাকায় নদীর তীরে গাছ কেটে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। কাটা গাছের অন্তত ৩২টি অবশিষ্ট নিচের অংশ (গোড়া) খুঁজে পাওয়া গেছে, যা সম্প্রতি কাটা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, গত সপ্তাহখানেক ধরে গাছগুলোকে কাটা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দশক পুরোনো কড়ই ও বটগাছসহ অর্ধশতাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আরও গাছ কাটা হবে।

মাছঘাট এলাকায় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটি কড়ই গাছের নিচে সবজি বিক্রি করতেন শাহানুর বেগম নামে ষাটোর্ধ্ব এক নারী। শনিবার দুপুরে তাকে রোদ থেকে বাঁচতে মাথার উপর একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ টেনে রাখতে দেখা যায়। কারণ, অন্তত দশক বয়সী যে কড়ই গাছটি এতদিন তাকে ছায়া দিচ্ছিল, সেটি আর নেই।

কেটে ফেলা গাছটির গোড়া দেখিয়ে এই নারী বলন, ‘আমি কয়েক বছর ধরে এখানে সবজি বিক্রি করি। গ্রীষ্ম বা বর্ষায় এই গাছ আমারে আরাম দিতো। এখন চারিদিকে ছায়ার মতো কিছু নাই। আমরা সবাই এখানে গরীব মানুষ, ছাতা নিয়ে বসা সম্ভব না। এই ব্যাগ মাথায় দিয়া রইদের তাপ থেকে বাঁচতেছি।’

‘আমরা শুনেছি এইখানে সরকারি ভবন করা হইবো তাই গাছ কাটা হইছে। গাছ কাটায় কষ্ট হইলেও আমাদের কথা তো কেউ চিন্তা করে না’, বলেন শাহানুর।

এদিকে, নির্বিচারে গাছ কাটার প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতিকর্মী। রোববার দুপুরে তারা বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে স্মারকলিপি দিয়েছেন। এর আগে, গত বুধবার নদীর তীরে যেখানে গাছ কাটা হচ্ছে সেখানে মানববন্ধনও করেছেন তারা। প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সেখানে দুই দিনব্যাপী আলোকচিত্র প্রদর্শনীও করা হয়েছে।

স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুসারে শীতলক্ষ্যা নদীর নারায়ণগঞ্জ মহানগর অংশ প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। আইন অনুসারে এই এলাকার প্রাকৃতিক গাছপালা কাটা কিংবা আহরণ এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী সকল প্রকার কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ কার্যালয় তাদের নতুন স্থাপনা ও গাড়ি পার্কিং নির্মাণের জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর তিন নম্বর মাছ ঘাট এলাকার শতাধিক গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলেছে। এছাড়াও তারা মাছ ঘাটের প্রাচীন বটগাছটিও কাটার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে বট গাছটির গাছের প্রায় সকল শাখা ও কাণ্ডের একাংশ কেটে ফেলা হয়েছে। এতে করে ওই এলাকার পাখপাখালি, পোকামাকড়সহ গাছগুলির উপর নির্ভরশীল অসংখ্য প্রাণ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। পাশপাশি প্রাচীন বটগাছটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা শহরের সাংস্কৃতিক পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দেশের নদী রক্ষার দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএ-র এমন কর্মকাণ্ডে আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী গভীর উদ্বিগ্ন।’

গাছ কাটার এই কার্যক্রমকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে ‘শীতলক্ষ্যা পাড়ের গাছ রক্ষায় নারায়ণগঞ্জবাসী’ আন্দোলনের সমন্বয়ক কবি আরিফ বুলবুল বলেন, “নদীর তীরে নিরিবিলি জায়গা হওয়ায় এটি ছিল সংস্কৃতিকমনা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলা। এটি বিভিন্ন পাখি এবং অন্যান্য প্রজাতির বাসস্থানও ছিল। এমন একটি ছায়া-সুনিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে ইট-পাথরের দালান তৈরি করা একটি অদরকারি কাজ। কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি নির্বিচারে এভাবে গাছ কেটে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে না। আমি এটাকে গণহত্যাই বলতে চাই।”

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুসারে, শীতলক্ষ্যা নদীর চারপাশের এলাকাসহ দেশের ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা (ইসিএ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেশগত সংকটাপূর্ণ এলাকাগুলোতে প্রাকৃতিক বন ও গাছ কাটা বা আহরণ, প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী কার্যকলাপসহ নয়টি কার্যক্রম সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে আইনে।

আইনের বিষয়টি উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সমন্বয়কারী ও পরিবেশবাদী সংগঠন ‘প্রতিবেশ আন্দোলন’-এর সদস্য তরিকুল সুজন বলেন, “ইসিএ তালিকায় শীতলক্ষ্যা নদী রয়েছে ১২ নম্বরে। বিআইডব্লিউটিএ নির্মাণের জন্য এই নদীর তীরের শতাধিক গাছ কেটে ফেলেছে যা গ্রহণযোগ্য নয়।

“আমরা বিশ্বাস করি যে, এই গাছগুলো রেখেই অবকাঠামো তৈরি করা যায়। শুধু বিদেশে নয়, আমাদের দেশেও এমন উদাহরণ রয়েছে। গাছ কেটে আমরা কোনো স্থাপনা হতে দেবো না। তারা যদি গাছ কেটে এটি নির্মাণ করতে চায় এবং তাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে দায়ভার বিআইডব্লিউটিএ’কেই নিতে হবে।”

অবগত না করে বিআইডব্লিউটিএ’র এই গাছ কাটার কর্মকাণ্ডে খুশি নয় খোদ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনও।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মঈনুল ইসলাম বলেন, “নগর এলাকায় যে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করার আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। কিন্তু, বিআইডব্লিউটিএ তাদের কাজের বিষয়ে আমাদের জানায়নি। শীতলক্ষ্যার আশপাশের এলাকা ইসিএ তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমরা জানতে পেরেছি যে বেশ কিছু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে যা নিশ্চিতভাবে বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাহত করবে। সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।”

অন্যদিকে, এই প্রকল্পটি রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানকেও বাধাগ্রস্ত করবে, কারণ এই এলাকাসহ আশেপাশের এলাকা নিয়ে একটি ‘মাল্টিমডাল হাব’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে রাজউকের, যোগ করেন নাসিকের এই কর্মকর্তা।

তবে, যোগাযোগ করা হলে বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের নির্বাহী প্রকৌশলী নিজাম উদ্দিন পাঠান বলেন, “নদীর পাড়ে এই এলাকায় একটি টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পের কারণে কিছু গাছ কাটতে হয়েছে। গাছগুলো বিআইডব্লিউটিএ’র জমিতেই ছিল। নিয়ম মেনে আমরা বন বিভাগ ও বিআইডব্লিউটিএ’র অনুমতি নিয়ে গাছ কেটেছি।”

সর্বশেষ

জনপ্রিয়