১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ১১:৫২, ২৬ মার্চ ২০২৩

আপডেট: ২৩:০২, ২৬ মার্চ ২০২৩

একাত্তরে নারায়ণগঞ্জের বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের ইতিহাস

একাত্তরে নারায়ণগঞ্জের বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের ইতিহাস

প্রেস নারায়ণগঞ্জ: একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের যেমন রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। তেমনি যুদ্ধের নয় মাসে নারায়ণগঞ্জে ব্যাপকহারে গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী, তাদের সহযোগী জামায়াত ইসলাম ও দোসর আলবদর, আলশামস বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রয়েছে নারায়ণগঞ্জের সেই ত্যাগ ও গৌরব গাঁথা। অসংখ্য গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের নাম রয়েছে সেই ইতিহাসে। গণকবর অসংরক্ষিত থাকায়, গণহত্যার বিবরণ না থাকায়, বধ্যভূমির স্মৃতি সংরক্ষিত না হওয়ায় একাত্তরের সেই সব স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। ড. মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধকোষ দ্বিতীয় খণ্ড’ এবং রীতা ভৌমিকের `গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ` এ রয়েছে এমন কিছু গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের নাম। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াল নৃশংস ঘটনা ও ত্যাগের ইতিহাসকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রেস নারায়ণগঞ্জ পুনঃপ্রকাশ করছে নারায়ণগঞ্জের কিছু গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের নাম। আমরা মনে করি একাত্তরের চেতনায় গণহত্যা, বধ্যভূমি, নির্যাতনকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে।

২০১৮ সালে ৩০ মার্চ নারায়ণগঞ্জের গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের হিসাব প্রকাশ করে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র। এতে নারায়ণগঞ্জে ২৮৮টি গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। নারায়ণগঞ্জে রয়েছে ২০৯ গণহত্যা, ২৩ বধ্যভূমি, ১০ গণকবর ও ৪৬টি নির্যাতনকেন্দ্র।

বক্তাবলী গণহত্যা
নারায়ণগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চল ধলেশ্বরীর পাড় ধরে বক্তাবলীর ২২টি গ্রাম। বক্তাবলী ও আলীরটেক দুটি ইউনিয়নের সমন্বয়ে বক্তাবলী পরগনা। তখন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জের দিকে সরে যাওয়ার নিরাপদ পথটি ছিল এই বক্তাবলী। বক্তাবলীর পূর্বে ও দক্ষিণে ধলেশ্বরী, আর উত্তরে বুড়িগঙ্গা নদী। দুই নদীর মাঝখানে বক্তাবলীর ২২টি গ্রামের অবস্থান।

নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় ১৯৭১-এর ২৯ নভেম্বরের ঘন কুয়াশার রাতে ৩টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে পুরো বক্তাবলী। গানবোট নিয়ে ধলেশ্বরীর বুকে তারা অবস্থান নেয়। সুবেহ সাদেকের সময় বক্তাবলীর চরে গানবোট ভিড়িয়ে নদীর পাড়ে নামতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। ঘন কুয়াশা যে কোনো কারণেই হোক তারা গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়নি। তখন মুক্তারকান্দি প্রাইমারি স্কুল, কানাইনগর হাইস্কুলসহ বক্তাবলীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ক্যাম্প ছিল। নদীর পাড়ে অবস্থিত ডিক্রিরচর মসজিদ ও বিভিন্ন বাড়িতে রাত কাটাতেন মুক্তিযোদ্ধারা। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি সঙ্গে সঙ্গেই টের পেয়ে যায় এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কুয়াশা একটু কাটলে কুঁড়ের পাড় অঞ্চলের নদীর কাছ থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্রথমে গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে পাকিস্তানিরা। সকাল প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রায় দুই ঘন্টার প্রতিরোধ যুদ্ধে পাঁচ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আহতও হয় বেশ কজন পাকসেনা। ৫টি লাশ ও আহত দুজনকে কাধে নিয়ে পিছু হটে পাকিস্তানি সেনারা। এই প্রতিরোধের কারণে বক্তাবলীর গ্রামগুলো থেকে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মুন্সিগঞ্জ ও বিভিন্ন অঞ্চলে সরে যেতে পারে। এরপর পাকিস্তানি সেনা বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর। পাক হানাদারদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মুখে পিছু হটে মুক্তিবাহিনী। আর তখনই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডব। তারা ডিক্রিরচর নদীর পাড়ে ৪০ জন গ্রামবাসীকে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে হত্যা করে। লক্ষ্মীনগর কবরস্থানের কাছে খড়েরপাড়ার ভেতরে আশ্রয় নেওয়া দলবদ্ধ গ্রামবাসীদের আগুন জ্বালিয়ে হত্যা করে। রাজাপুরের হলুদ সরিষা ক্ষেতে পড়ে থাকে লাশের পর লাশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদুল্লাহ, মুনীরুজ্জামানসহ বহু ছাত্র আর সাধারণ কৃষককে হত্যা করে তারা। বক্তাবলীতে ১৩৯ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। বক্তাবলী পরগনার ২২টি গ্রামই গান পাউডার দিয়ে বিকেলের মধ্যে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় ওরা। অনেককে গুলি করে হত্যার পর ধলেশ্বরী নদীতে ফেলে দেয় হানাদার বাহিনী।

আজ চল্লিশ বছর পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ছাত্রদের তালিকায় যেমন এ বক্তাবলীর শহীদদের নাম নেই, স্থানীয় জেলা প্রশাসনের শহীদদের তালিকাতেও এই ১৩৯ জনের একজনেরও নাম নেই। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ২২টি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই আশ্রয় পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। এ গ্রামগুলোর ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক প্রত্যেকেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।

ফতুল্লা পঞ্চবটি হরিহরপাড়া বধ্যভূমি
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পঞ্চবটিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন যমুনা অয়েল ডিপো (তৎকালীন ন্যাশনাল অয়েল মিল) মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে। যুদ্ধকালীন পুরো ৯ মাস নির্যাতন ও বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছে তারা। নির্যাতনের পর হাত-পা বেঁধে মানুষকে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিতো। পচে ফুলে বহু লাশ নদীতে ভেসে উঠেছে সে সময়। বিশেষ করে এই মিলের ভেতরে একটি টিন কারখানার ভিতরে নারীদের ওপর অত্যাচার করা হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিলের ভেতর থেকে নারীদের নির্যাতনের বহু আলামত পাওয়া গেছে। সেসময় ন্যাশনাল অয়েল মিলটির মালিক ছিল পাকিস্তানের সবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ছেলে গহর আইউব। বর্তমানে মিলটির এক পাশে বধ্যভূমি লেখা সাইনবোর্ড রয়েছে। সে সময় সেখানে কি পরিমাণ মানূষ হত্যা ও নির্যাতন করা হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই।

আলীগঞ্জ সরকারি পাথর ডিপো বধ্যভূমি
ঢাকা-নারায়নগঞ্জ সড়কে আলীগঞ্জ সরকারি পাথর ডিপো ছিল পাক হানাদার বাহিনীর আরেকটি বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস এখানে অগণিত বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের একজন নীরব প্রত্যক্ষদর্শী এই পাথর ডিপোর চৌকিদার ইয়াকুব আলী হাওলাদার (৭০)। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী ২৬ মার্চ, শুক্রুবার পাকবাহিনী পাগলা মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জেমসহ ৬ জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তারপর থেকেই ব্যাপকভাবে এই বধ্যভূমিতে বাঙালি নিধন শুরু হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা অসংখ্য বাঙালিকে এখানে রাতের অন্ধকারে জবাই করা হতো। তাঁদের হাত মুখ চোখ বাঁধা থাকত। অনেক সময় নিহতদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য তাঁদের লাশ বড় বড় পাথরে বেঁধে পার্শ্ববর্তী জলাশয় ও বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হতো। এছাড়া অন্যান্য স্থানে নিহত বাঙালিদের লাশও ট্রাকে বোঝাই করে এখানে এনে ফেলা হতো। চৌকিদার ইয়াকুব আলী এই বধ্যভূমিতে কতজন বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে তা বলতে পারেননি। তবে একটি স্থান দেখিয়ে বলেন যে, একদিনেই এখানে ৮০ জনকে হত্যার পর ফেলে রাখা হয়েছিল। সে সময় লাশের স্তূপের পচা গন্ধে ফতুল্লা থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত যাতায়াতকারীদের নামে রুমাল চাপা দিতে হত, বস্তুত রস্তার উভয়পাশে প্রকাশ্যে লাশের স্তূপ রেখে স্বাধীনতাকামী বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করাই ছিল পাকবাহিনীর মূল উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য, উপরোক্ত বধ্যভূমির পাশে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জবাইখানা ছিল, যেমন – কবির রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ, পাকিস্তান ন্যাশনাল ওয়েল ডিপো, পাগলার কালির ঢিপি, দৌলেশ্বর তেল মিল ও ব্যাকল্যান্ড গভর্নর জেটি।

ফতুল্লার শাসনগাও গণকবর
ঢাকা-নারায়নগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ সড়কের নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পঞ্চবটি শাসনগাও মেথর খোলায় (বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ট্রাক টার্মিনাল) গণকবর রয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ট্রাকে করে লাশ এনে (বর্তমান ট্রাক টার্মিনালের স্থানে) মাটিতে গর্ত করে গণকবর দেওয়া হয়েছে।

ফতুল্লার জমিদার বাড়ি বধ্যভূমি
নারায়নগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার ধর্মগঞ্জ হরিহরপুর হাইস্কুল সংলগ্ন জমিদার বাড়িতে ২৯ মার্চ গুলি করে প্রণব কুমার দে ও খোকন সাহা নামের দু’জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রণব কুমারের বাবা পুলিশের সেকেন্ড অফিসার ছিলেন।

আদমজী জুট মিল নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি
নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুট মিলের আনসার ক্লাব, ঢাকা বাজু ছিল পাকসেনাদের ক্যাম্প। হানাদাররা আনসার ক্লাবের মাঠের দক্ষিণ পাশে পুকুর পাড়ে বড় কূপ খনন করে লাশ ফেলার জন্যে। যুদ্ধকালীন সময়ে নিরীহ শ্রমিকদের টাকা-পয়সা লুট করে বিহারি রাজাকাররা পাকসেনাদের হাতে তুলে দিত। এই ক্যাম্পে গুলি করে যাদের মারা হয় তাঁদের মৃতদেহগুলো এই কূপে ফেলে দেয়া হতো।

নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, চিটাগাং সড়ক, মিজিমিজি গ্রাম, গোদনাইল থেকে নিরীহ যুবক যুবতীদের জোরপূর্বক টেডিগেট (নিউ কলোনি), ঢাকা বাজুতে ধরে আনত রাজাকার ও হানাদাররা। টেডিগেটের খালের পাড়ে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে। খালের পাশে গর্ত তৈরি করে মৃতদেহগুলো ওইখানে পুঁতে রাখে।

মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে জালকুড়ি গ্রামের কয়েক বাড়িতে পাকসেনারা আগুন ধরিয়ে দেয়। আদমজী মিলের পাওয়ার হাউস বরাবর হানাদার বাহিনীর গাড়ি দেখে আফসার উদ্দীন পাক আর্মিকে গুলি করে। পাক আর্মিরা সাথে সাথে আফসার উদ্দীনকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে। সেখানেই সে স্পট ডেথ হয়।

মুক্তিযোদ্ধারা সস্তাপুর রেললাইন অপারেশন করার পর বর্বর বাহিনীর সস্তাপুর গ্রামবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করে।

নভেম্বর মাসের ২০-২৫ তারিখের দিকে পাকসেনারা বাড়িপাড়া রেললাইন পুলের সামনে লস্কর আলী নামে এক লোককে গুলি করে হত্যা করে।

পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে সেনার পাড়া গ্রামে হামলা চালায়। গ্রামের ৭-৮ মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়। পাকসেনারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি তন্নতন্ন করে খোঁজে।

এক পাক আর্মি জমিলা বেগম নামে এক মহিলার কাছে পানি খেতে চায়। তাঁর সঙ্গীরা তাকে সেখানে রেখে চলে আসে। জমিলা বেগম পাক আর্মিকে পানি খেতে দিয়ে পেছন থেকে তাঁর মাথায় মুশল (ধান ভানার দণ্ড) দিয়ে আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে পাক আর্মিটা মাটিতে পড়ে যায়। মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই জমিলা মুশল দিয়ে আরো কয়েকটা আঘাত করেন। আঘাতের ফলে পাক আর্মিটি সেখানেই মারা যায়। লাশটিকে তিনি খড় দিয়ে ঢেকে রাখেন।

আদমজী নগর শিমুলপাড়া বধ্যভূমি
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের বিলুপ্ত আদমজী জুটি মিলের বিহারি ক্যাম্প ‘জম ঘর’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জুট মিলের পাম্প হাউজের ভেতরে নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতনের ও গুলি করে হত্যার পর পানির পাম্প দিয়ে লাশ ধুয়ে নদীতে ফেলে দিতো। স্থানটি এলাকাবাসীর কাছে ‘জম ঘর’ হিসেবে পরিচিতি পায়। যুদ্ধের পর এখান থেকে মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এছাড়া মিলের বেশ কয়েকজন শ্রমিককেও হত্যা করেছে হানাদাররা। স্বাধীনতার পর এই বধ্যভুমিটির সন্ধান পাওয়া যায়।

পাকসেনারা নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করে আদমজী জুট মিলের বিহারি ক্যাম্পের ভিতরের পুকুরে নিক্ষেপ করত। স্বাধীনতার পর এ পুকুর থেকে মানুষের হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই এই বধ্যভুমিটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। আদমজীনগর জুট্মিলের বেশ কিছু শ্রমিক এখানকার একটি ডোবা থেকে অনেক নরকঙ্কাল উদ্ধার করে। পাকহানাদার বাহিনী বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে হত্যা করতো। এছাড়া এই মিলের বেশ কয়েকজন শ্রমিককেও তারা হত্যা করেছে বলে জানা যায়।

সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে মেঘনা পেট্রোলিয়াম গণকবর
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রণাধীন মেঘ্না প্রেট্রোলিয়াম ডিপোতে (তৎকালীন এসও) গণকবর রয়েছে। একাত্তরের ২৯ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্যাম্প বসিয়ে সেখানে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করতো। স্বাধীনতার পর সেখান থেকে মানুষের হাড়গোড় পাওয়া যায় বলে জানান নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফজলুল হক। তবে সেখানে বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই।

সিদ্ধিরগঞ্জের বার্মাস্ট্যান্ড পদ্মা অয়েল বধ্যভূমি
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন পদ্মা পেট্রোলিয়াম ডিপোতে (বার্মা স্ট্যান্ড) জেটিতে মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিতো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

বন্দর গণহত্যা
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বন্দর উপজেলার সিরাজদৌল্লাহ ক্লাব মাঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ৫৪ জন নারি-পুরুষকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। হত্যার পর লাশগুলো গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে তারা। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় বাড়িঘর।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহকারী ও যুদ্ধকালীন সময়ে বন্দর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জানান, ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল ভোরে নৌপথে এসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে বন্দরে আক্রমণ চালায়। তারা বন্দর সিরাজদৌল্লাহ ক্লাব মাঠে সাধারণ ৫৪ জন নারী-পুরুষকে ধরে এনে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। হত্যার পর লাশের উপর মুলি বাশের বেড়ার দিয়ে গান পাউডার দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বন্দর আমিনপুর, সোনাকান্দা ডকইয়ার্ড, র‍্যালিবাগান, সিএসডি, ইস্পাহানিসহ বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করে। তারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালাতো। ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে নবীগঞ্জ থেকে বন্দর স্টেশন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিরা বাংকার থেকে বেরিয়ে এসে আক্রমণ করে। ব্রাশফায়ারে মিত্র বাহিনীর ৮ ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়। ২ মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। ঐ দিন বিকেল থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা নবীগঞ্জে ১৫ রাজাকারকে ধরে হত্যা করে।

সেদিনের ঘটনায় শহিদ হওয়া ৫৪ জনের ২৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এঁরা হচ্ছে, ছমিরউদ্দিন সরদার, মন্তাজ উদ্দিন মাস্টার, আলী আকবর, রেজাউল ইসলাম, বাবুল, আমির হোসেন, নায়েব আলী, আলী হোসেন, ইউসুফ আলী, সুরুজ চন্দ্র, যবুনা চন্দ্র কানু, লছমন চন্দ্র কানু, কানাই লাল কানু, গোপাল চন্দ্র, ভগবত দাস, দুগচিরন প্রসাদ, নারায়ণচন্দ্র প্রসাদ, ইন্দ্রচন্দ্র দাস, সুরেশ চন্দ্র দাস, দিগেন্দ্র চন্দ্র বর্মন, বনেল চৌধুরী, মোবারক, হারাধন মাস্টার, নারায়ণ চৌধুরী, বাদশা খান, পরেশ খান।

শহরের নিতাইগঞ্জ গণহত্যা
নারায়ণগঞ্জ শহরের আর কে দাস রোড নিতাইগঞ্জে একাত্তরের ৭ এপ্রিল পোদ্দার বাড়িতে ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

বিআইডব্লিউটিএ-১ জেটি
নারায়ণগঞ্জ শহরের বিআইডব্লিউটিএ ঘাট জেটিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লোকজনকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিতো।

আড়াইহাজার থানা গণহত্যা ও নির্যাতন
পাকসেনারা আড়াইহাজার থানার ৭ জন হিন্দু লোককে এপ্রিল মাসের ১৫-১৬ তারিখে হত্যা করে। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করে।

প্রভাকরদির দুজন রাজাকার গোলাম মোস্তফা ও ফারুক পাকসেনাদের আড়াইহাজার থানার খবরাখবর প্রেরণ করত। মুক্তিযোদ্ধারা এটা জানতে পেরে গোলাম মোস্তফাকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল, আশি রাউন্ড গুলি ও ৪টি গ্রেনেডসহ গ্রেফতার করে থানা কমান্ডারের কাছে হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে মোস্তফা ও ফারুক দুজনেই স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেন।

আড়াইহাজার থানার রাজাকার আতাদি গ্রামের ফজলুল রহমান, এরফান ভূঁইয়া, মনির, সাকি, শান্তি কমিটির সভাপতি পূর্ব আতাদি গ্রামের আকরাম উদ্দীন ভূঁইয়া, শম্ভুপুরা গ্রামের আলমগীর, মোহনপুর গ্রামের সোনামিয়া এরা আড়াইহাজার থানার গ্রামগুলতে নির্যাতন ও লুটপাট করে এবং হিন্দুপাড়ার যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে পাকসেনাদের ক্যাম্পে পৌছে দেয়। যুবতীদের ওপর হায়েনারা চালাত পাশবিক নির্যাতন। এসব রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা আড়াইহাজার থানা থেকে উতখাত করলে তারা নারায়ণগঞ্জে এসে আশ্রয় নেয়।

ধরগা গ্রামে খানসেনারা প্রবেশ করে বাড়ি থেকে হাঁস–মুরগি ধরে নিয়ে যায়। মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করে। সংবাদটা শোনামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের শায়েস্তা করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আগস্ট মাসে পাকসেনারা এমপি ডা. সাদত আলী সিকদারের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং ঘোষণা দেয় কোনো এমপি, এম. এন. এ ধরে দিতে পারলে তাকে আড়াই লক্ষ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে।

উদ্ববগঞ্জ নির্যাতন কেন্দ্র
নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁর উদ্ববগঞ্জ আর্মি ক্যাম্প ছিল পাকিস্তানিদের অপর নির্যাতন কেন্দ্র। রাজাকার ময়েজউদ্দীন সফেদার পাকসেনাদের খুশি করার জন্যে আমিনপুর ইউনিয়নের শাহপুর গ্রামের প্রনব ঘোষের মেয়ে বিভা রানী ঘোষকে (ছাত্রী) ধরে আনে। তুলে দেয় এ. এস. এম. সোলায়মানের সহযোগী জমির আলী কেরানির হাতে। জমির আলী কেরানি পাকসেনা ক্যাম্পে (বর্তমানে টি.এন.ও-এর বাসা উদ্ববগঞ্জ) হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। হানাদার বর্বররা মেয়েটিকে পাশবিক নির্যাতনের পর অর্ধমৃত অবস্থয় ছেড়ে দেয়।

সোনারগাঁয়ের নির্যাতন প্রসঙ্গে সংবাদদাতা লিখেছেন, জমির আলী কেরানির নেতৃত্বে পাকবাহিনী বৈদ্যেরবাজার স্কুলের পূর্ব-উত্তর দিকে নরেন্দ্র প্যাটেলের বাড়িতে হামলা করে। তঈয়েবুর রহমান সে সময় ঘটনাস্থলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যান এবং নৌকায় করে ৫ যুবতী মেয়েকে পার্শ্ববর্তী আড়াইহাজার থানার দুবদাড়া গ্রামে নিরাপদে পৌছে দেন।

সম্মানদী গ্রামে শতাধিক, কোম্পানীগঞ্জে দশটি, সাথীপুরে পাচটি এবং পিরোজপুর গ্রামের সব বাড়িই রাজাকাররা জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। জমির কেরানি ও আলাউদ্দিন, এ.এস.এম. সোলায়মানের পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্নিকান্ড, নারী সরবরাহ করত।

এ.এস.এম. সোলায়মানের বিশ্বস্ত অনুচর টেক্কা সামসুর নেতৃত্বে পাকবাহিনী হাতকোপা গ্রামে আক্রমণ করে যুবতী মেয়েদের ধরে আনার জন্য। রাজাকার সামসুর নেতৃত্বে পাকবাহিনী গেম ঢুকলে মেয়েরা পার্শ্ববর্তী পাটক্ষেতে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করে।

ভৌগলিক দিক থেকে বন্দর এলাকা হওয়ায় সার্বক্ষনিকভাবে সে অঞ্চল দিয়ে পণ্যবাহী বিভিন্ন ধরণের নৌকা, ট্রলার, জাহাজ, চলাচল করে। এ.এস.এম. সোলায়মান রাজাকার বাহিনীর মাধ্যমে ওইসব পণ্যবাহী নৌযানের যাবতীয় চাল, ময়দা, চিনি, তেল, সার, চা বিভিন্ন দ্রব্যাদি টাকা পয়সা লুট করত। ব্যবসায়ীরা পণ্য হারিয়ে সম্মানদী গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে জানায়। এ সংবাদ রাজাকাররা পাকবাহিনীকে জানালে ২০-২৫ জন রাজাকারসহ শ’দুয়েক পাকসেনা সম্মানদী গ্রামে হামলা চালায়। রাজাকাররা যাওয়ার সময় সম্মানদী গ্রামের দুজন মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়। মেয়ে দুটি পরবর্তীকালে আর ফিরে আসেনি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়- শাহপুর, বানীনাথপুর, জয়রামপুর, ভট্টপুর, বাড়িরঘুভাঙা, রামগঞ্জ ও পঞ্চবটী গ্রামে হিন্দু বসতি বেশি থাকায় রাজাকারদের দৃষ্টি ছিল সেদিকেই। এ.এস.এম. সোলায়মানের সম্মতিতে জমির কেরানি ও সামসুর নেতৃত্বে রাজাকাররা হিন্দু নাগ বংশের যুবতী মেয়ে ও জেলেপাড়ার মেয়েদের ধরে এনে বৈদ্যেরবাজারের পাকবাহিনী ক্যাম্পে সরবরাহ করত।

এছাড়াও সোনারগাঁয়ে এ.এস.এম. সোলায়মান কতৃক রাজাকার বাহিনীর ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও গুপ্ত হত্যার বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া গেছে সাক্ষ্য প্রদানকারী স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে।

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়