২৯ মার্চ ২০২৪

প্রকাশিত: ২৩:০২, ২৩ মার্চ ২০২৩

আপডেট: ১৯:০৫, ২৪ মার্চ ২০২৩

গরীবের ওএমএস’র চালে ভাগ বসালেন কাউন্সিলর বাবু

গরীবের ওএমএস’র চালে ভাগ বসালেন কাউন্সিলর বাবু

সৌরভ হোসেন সিয়াম (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): সরকারি চাল নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে বিতরণ না করে নিজেই কিনে রেখে দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু। কাগজে-কলমে গত ২১ মার্চ কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে ২ টন চাল বিক্রির উল্লেখ থাকলেও সেই চাল বিক্রি না করে মজুদ করে রেখে দিয়েছেন তিনি। গত দুইদিনের সরেজমিন অনুসন্ধানে এই তথ্য উঠে এসেছে।

নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে বিতরণ না করে নিজেই কিনে রাখার বিষয়টি কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু অস্বীকার করলেও ওইদিনের নির্ধারিত ডিলার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

আব্দুল করিম বাবু নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের এক নম্বর প্যানেল মেয়র এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য। স্থানীয়ভাবে তার বেশ প্রভাব রয়েছে। তিনি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী বলে পরিচিত।

৩০ টাকা কেজি দরে একজনকে সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল বিতরণ করার কথা ছিল। সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) এর মাধ্যমে মূলত নিম্নবিত্তের মানুষের জন্য এ চাল। প্রতি সপ্তাহে ২ টন (২০০০ কেজি) চাল একটি ওয়ার্ডে বরাদ্দ দেওয়া হয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতি এবং স্থানীয় কাউন্সিলরের তদারকিতে এই চাল বিক্রি করেন নির্ধারিত ডিলার।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২১ মার্চ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবুর কার্যালয়ের সামনে ওএমএস’র ট্রাক গিয়েছে। ওইদিন ২ টন চাল স্থানীয় নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে ১৫০ টাকায় ৫ কেজি চাল বিক্রি করার কথা। ওইদিন চাল বিক্রির জন্য নির্ধারিত ছিলেন ডিলার সাদ্দাম হোসেন।

তবে ওইদিনের চাল সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করা হয়নি। চাল কিনে নিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর।

নারায়ণগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে কথা হয় সাদ্দাম হোসেনের বাবা আক্তার হোসেন বাবুলের সাথে। তিনি বলেন, সরকারিভাবে ডিলারের তালিকায় তার ছেলের নাম থাকলেও সবকিছু দেখাশোনা করেন আক্তার হোসেন বাবুল। গত ২১ মার্চও তিনিই সব তদারকি করেছেন। ওইদিনের চাল কিনে রেখেছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু।

গত দুইদিন স্থানীয় অন্তত ২২ জনের সাথে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে সাতজন রয়েছেন যাদের বসবাস কাউন্সিলর কার্যালয়ের ৫০ গজের মধ্যে। তারা ওএমএস’র চালের নিয়মিত ক্রেতা। স্থানীয়ভাবে কাউন্সিলর খুবই প্রভাবশালী হওয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।

তাদের ভাষ্য, গত ২১ মার্চ কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে ট্রাকে কোন চাল বিক্রি করা হয়নি। অন্য সময় স্থানীয় পাইকপাড়া জামে মসজিদে চাল বিক্রির কথা মাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়। ওইদিন মাইকেও জানানো হয়নি।

পাইকপাড়া জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. শাহীন বলেন, ‘চাল বিক্রির ট্রাক আসার কথা থাকলে কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। ওই অনুযায়ী আমরা মাইকে এলাকাবাসীকে জানিয়ে দেই। মঙ্গলবার (২১ মার্চ) ট্রাক আসবে এমন কোন নির্দেশনা কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে জানানো হয়নি। এই কারণে মসজিদের মাইকেও কোন ঘোষণা দেওয়া হয়নি।’

স্থানীয় একাধিক সূত্র বলছে, ওইদিন পুরো ট্রাকের চালগুলো নামিয়ে রাখা হয় কাউন্সিলর কার্যালয়ের পাশের আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ দু’টি কক্ষে। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পরিষদের সভাপতি কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু। বিদ্যালয়টির ভেতরে বাবুর তত্ত্বাবধানে দু’টি কক্ষ রয়েছে। তালাবদ্ধ এই কক্ষ দু’টির চাবি সবসময় কাউন্সিলর বাবুর কাছেই থাকে। গত বুধবার এই প্রতিবেদক চালের এই অনিয়ম প্রসঙ্গে অনুসন্ধান করছেন, এমনটা টের পেয়ে রাতেই চালগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয় বলেও জানাচ্ছে ওই সূত্রটি।

জানতে চাইলে আক্তার হোসেন বাবুলও বলেন, ‘আমরা কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানে চাল বিক্রি করি। তিনি যেইভাবে, যেইখানে বিক্রি করতে বলেন সেইভাবেই বিক্রি করা হয়। মঙ্গলবারের সব চাল তিনি কিনে রেখে দেন। তিনি নিজে যদি বলেন, চালগুলো তাকে দিয়ে দিতে সেক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না। উনি চালগুলো নামিয়ে আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভেতরে রাখেন।’

গত ২১ মার্চের কথা স্বীকার করলেও এর আগের সপ্তাহগুলোতে একইভাবে চাল মজুদ করার ব্যাপারটি স্বীকার করেননি ওএমএস’র চাল বিক্রির এই ডিলার। যদিও গত ৫ মার্চ, ২৩ ফেব্রুয়ারি ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে একই ওয়ার্ডে চাল বিতরণের তালিকায় ছিলেন একই ডিলার। মাঝে ১৫ মার্চ ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকায় ছিল মো. ফরিদ নামে আরেক ডিলার।

জানতে চাইলে ডিলার মো. ফরিদ বলেন, ‘মাঝে মাঝে কয়েক বস্তা কাউন্সিলর রেখে দেন। ওইদিনও কয়েক বস্তা চাল রেখে দিছেন। এইটা আমার লোকজন আমারে জানাইছে। এমনটা তো হয়ই।’

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাইকপাড়ায় অবস্থিত আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টিতে শেষ কার্যদিবস ছিল বৃহস্পতিবার। ঈদের ছুটি হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়টিতে রঙের কাজ করানো হচ্ছিল। গত দুই সপ্তাহ যাবৎ রঙের কাজ করছেন ছয়জন রঙমিস্ত্রি। তাদেরই একজন বলেন, ‘চালগুলো ট্রাক থেকে নামিয়ে স্কুলের ওই দুই ঘরে (বিজ্ঞান ভবনের কক্ষ নম্বর ১০১ ও ১০২) রাখা হইছিল।’

তবে কক্ষ দু’টি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। বিদ্যালয়ে তখন কোন শিক্ষককেও পাওয়া যায়নি। কক্ষ দু’টির চাবি সবসময় সভাপতির (কাউন্সিলর) কাছেই থাকে। ওই কক্ষ দু’টি তিনি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন বলে জানান বিদ্যালয়ে কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রতিবছরই এই স্কুলে চাল রাখেন কাউন্সিলর সাহেব। এইখানে চাল রেখে তা প্যাকেটিং করে ঈদ উপলক্ষে এলাকায় লোকজনের মাঝে বিতরণ করেন। গত মঙ্গলবারও অর্ধশতাধিক বস্তা চাল রাখা হয় স্কুলে।’

এই বিষয়ে জানতে চাইলে সম্পূর্ণ বিষয়টি অস্বীকার করেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু। তার দাবি, তিনি ২১ মার্চ সকাল দশটা থেকে সোয়া বারোটা পর্যন্ত ওএমএস’র চাল তার লোকজন দিয়ে বিতরণ করেছেন। অন্য সপ্তাহগুলোতেও একইভাবে তিনি চালগুলো বিতরণ করেন।
যদিও ডিলার জানিয়েছেন, সবগুলো চালই কিনে রেখে দিয়েছিলেন কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু।

কাউন্সিলর বলেন, ‘যারা কিনতে পারে না তাদেরকে আমি নিজের টাকায় চাল কিনে দেই। আমি কেন সরকারি রেখে দেবো? আমি কি এই চাল বিক্রি করে খাওয়া লোক?’

সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) এর মাধ্যমে মূলত নিম্নবিত্তের মানুষের জন্য চালসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করা হয়। এসব পণ্য বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করা হয়ে থাকে। নারায়ণগঞ্জ খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নির্দিষ্ট জায়গা থেকে যে কেউ ৩০ টাকা কেজি দরে সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি ওএমএসএ’র চাল কিনতে পারেন। একজন ব্যক্তির কাছে পাঁচ কেজির চেয়ে বেশি চাল বিক্রির নিয়ম নেই।

এই বিষয়ে কথা হলে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘এই ধরনের একটি তথ্য আমরা পেয়েছি। যারা সুবিধাভোগী তারা এই চাল পাবেন। এর বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এই ব্যাপারটি খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সরাসরি তদারকি করা হয়। আমরা অবশ্যই এই বিষয়ে যাচাই করবো। এই বিষয়ে প্রমাণ পেলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

একই কথা বললেন নারায়ণগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আসমা উল হোসনা। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ যাতে কম মূল্যে চাল কিনতে পারেন সেই ব্যবস্থা করেছে সরকার। একজন সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল কিনতে পারেন। কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানেই চাল বিতরণ করার কথা। ওই চাল বিক্রি না করে কাউন্সিলর যদি নিজেই রেখে দেন, তাহলে তা অপরাধমূলক কাজ। এমন অভিযোগের তদন্তে আমি কমিটি করবো। ওই কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি বিস্তারিত জেনে তারপর নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।’

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, ‘এই বিষয়ে খোঁজখবর করা হচ্ছে। সত্যতা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়