২৯ মার্চ ২০২৪

প্রকাশিত: ২১:০২, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আপডেট: ১৯:৩০, ২৩ এপ্রিল ২০২১

গোটা নদীটাই যেন খোলা নর্দমা

গোটা নদীটাই যেন খোলা নর্দমা

জুয়েল মিয়া (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): বর্ষা মৌসুমে শীতলক্ষ্যার পানি কিছুটা স্বচ্ছ হলেও শীতে আবার হয়ে ওঠে কালো। তীরে দাঁড়ালেই বিশুদ্ধ বাতাসের পরিবর্তে ভেসে আসে উৎকট গন্ধ। আশেপাশের বিভিন্ন কলকারখানা ও গৃহস্থালি বর্জ্যরে কারণে দূষণে দূষণে শীতলক্ষ্যা এখন মৃতপ্রায়।

গত কয়েকদিন সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বহুমুখী উদ্যোগে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। আশেপাশের বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্যমিশ্রিত পানি সরাসরি এসে পড়ছে শীতলক্ষ্যায়। গৃহস্থালি বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে নদীতে। নদর্মাও সংযুক্ত করা হয়েছে নদীর সাথে। পানি নর্দমার মাধ্যমে এসে পড়ছে শীতলক্ষ্যারই বুকে। এছাড়া বিভিন্ন নৌযান থেকে ফেলা হচ্ছে প্লাস্টিক ও পলিথিন। ধীরে ধীরে গোটা নদীটাই যেন তৈরি হয়েছে খোলা নর্দমায়।

শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকলে বিভিন্ন স্থানে চোখে পড়ে নদীর তীর ঘেঁষে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। দুই পারে সারি সারি বহুতল ভবন, শিল্পকারখানা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আর এসব কারখানা ও প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত হচ্ছে তরল ও কঠিন বর্জ্য। আর এদের শেষ স্থান শীতলক্ষ্যা। বর্জ্য মিশ্রিত কালো পানির উপর দিয়ে নৌ যান চললেই তৈরি হয় সাদা ফেনা।

প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহরের ব্যবসা-বাণিজ্য এই শীতলক্ষ্যা নদীকে কেন্দ্র করেই খ্যাতি লাভ করেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে ভ্রমণের একমাত্র পথ ছিল নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর। এ জন্য নারায়ণগঞ্জকে বাংলা ভ্রমণের প্রবেশদ্বার বলা হতো। এখনও এই নদীর উপর নির্ভর করে আছে কয়েক লাখ মানুষ। কিন্তু কিংবদন্তির সেই স্বচ্ছ সলিলা সুন্দরী নদীর পানি এখন শিল্পবর্জ্যে কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছে।

শীতলক্ষ্যা নদীর বেশ কয়েকটি জায়গায় দেখা গেল, নোংরা কালো রঙের পানিতে গোসল করছেন লোকজন। কেউ কেউ কাপড় ধোয়ার কাজটিও সারেন এই পানিতেই। নোংরা পানিতে কাপড় পরিস্কারের কারণ জানতে চাইলে তুলসি রাণী নামে এক নারী বলেন, ‘ঠেকায় পড়ে করতে হয়। বাসায় অনেক সময় পানি থাকে না।’ কাপড় দিয়ে দুর্গন্ধ আসে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছুটা গন্ধ তো আহেই, হালকা খলাইয়া লইয়া যাই, বাড়িতে গিয়া আবার খলাই।’

নোংরা পানিতেই গোসল করতে দেখা যায় মোছলেমকে। তিনি বলেন, আরও অনেকেই গোসল করে এই পানিতে। বর্ষায় আরও বেশি লোক গোসল করে। রোগবালাই হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হয়, মাঝে মাঝেই চুলকানি হয়।’

নদীর পাড়ের এক লোক বলেন, ‘এক সময় রোগ সারলে শীতলক্ষ্যায় গোসল করাইতো। রোগ থেকে মুক্তি পাইছে সেই খুশিতে। আর এখন এই পানিতে আজ গোসল করলে কালই বিভিন্ন রোগে ভুগতে হইবো।’

কর্মব্যস্ত শহরে প্রতিদিন নৌকায় করে নদী পাড়ি দিতে হয় হাজার হাজার মানুষকে। দুইপাড়ের কর্মজীবী মানুষ দুইবেলা নদী পাড়ি দেন নাক চেপে। নাকে রুমাল চেপে নৌকা থেকে নামছেন হোসিয়ারি শ্রমিক রহিম। তিনি বলেন, ‘কী আর করার। জীবিকার তাগিতেই আমাদের নদী পার হতে হয়। দুর্গন্ধের কারণে দম বন্ধ হয়ে আসে। নাকে কাপড় কিংবা রুমাল ধরে দুই বেলা পার হই।’

নদী তীরের মানুষেরা বলছেন, শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই নদীতে ফেলার ফলে দূষণ তৈরি হয়েছে। সেই সাথে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অবহেলা তো আছেই। শহরসহ শহরতলীর অধিকাংশ ড্রেন ও ক্যানেলের শেষ গন্তব্য শীতলক্ষ্যায়। এসব ড্রেন ও ক্যানেল দিয়ে বর্জ্য সোজা মিশে যাচ্ছে নদীর সঙ্গে। এছাড়া নদীর পাড়ে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আড়তের আবর্জনার স্তুপ। নারায়ণগঞ্জের সেন্ট্রাল ঘাট সংলগ্ন ওয়াকওয়ের সন্নিকটে গেলেই দেখা যায় শীতলক্ষ্যা দূষণের ভয়াবহ চিত্র।

শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গেলেই চোখে পড়ে নদীপাড়ে সবুজ শস্যের ক্ষেত। এ নদীর নোংরা পানি দিয়েই চলছে চাষাবাদ। দূষিত পানির সেচেই বেড়ে উঠছে সবজি। আর তাতে দেখা যায় বাতাসের উদ্যোম নাচ, রোদের হাসি। এ হাসিও শিগগির চাপা পড়বে পাকা দালান ও কারখানার নিচে। স্থানে স্থানে গেড়ে রাখা সাইনবোর্ডেগুলোই তার নির্দেশই দিচ্ছে।

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়