২৫ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ১৭:১৫, ৪ অক্টোবর ২০২০

ঘাতকের শহরে ত্বকীর জন্মদিন

ঘাতকের শহরে ত্বকীর জন্মদিন

রওনক রেহানা: ৫ অক্টোবর ত্বকীর জন্মদিন। পঁচিশ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৯৫ সালের এই দিনে ত্বকীর জন্ম। কিন্তু ত্বকীকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে সতেরো বছর পাঁচ সাসের মাথায়। কালের চক্রপ্রবাহে ত্বকীর বয়স বেড়ে চললেও বয়স তার আটকে আছে সতেরো বছর পাঁচ মাসের বৃত্তে। পিটার প্যানের মতো ত্বকীর বয়স আর বাড়বে না কোনদিন। তবে পিটার প্যান চিরদিন কিশোর হয়ে থাকার জন্যে পণ করেছিল; কিন্তু ত্বকী তা করেনি। ত্বকী বড় হতে চেয়েছিল, অনেক বড়, সবকিছু ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ঘাতকরা সে পথ রুদ্ধ করে ছুঁড়ে দিয়েছে এক রাশ অন্ধকার শুধু আমাদের দিকে নয়; গোটা সমাজের দিকে, ভবিষ্যতের দিকে।

জন্মদিন হয় আনন্দের; ফুল, কেক বিভিন্ন কিছু এর সাথে জড়িয়ে থাকে, কিšতু না ত্বকীর জন্মদিন আমাদের জন্যে কোনও আনন্দের বার্তা বয়ে আনে না। ত্বকী একটা ছড়া প্রায়ই শুনতে চাইতো, ‘মন্দরা ছিল মন্দরা আছে থাকবেও চিরকাল, তবুও ভালোর ছোঁয়া লেগে শুভ হোক আগামীকাল।’ আমি যখনই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘মানুষ’ কবিতা থেকে আবৃত্তি করতাম ‘মানুষ বড় কাঁদছে তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’- তখন প্রতিবারই আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার শিশুসšতান আপন মনেই বলে চলত ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও তোমাকে দাঁড়াতেই হবে’। এখন আমার কণ্ঠ থেকে কোনো ছড়া, কবিতা বা গান বেরোয় না, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। কিন্তু আমার চোখের জলে কোনো স্মৃতি মুছে যায়নি, ত্বকীর সাথের প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি মুহূর্ত থেকে আমি ফিরে পেতে চাই বর্তমান ও ভবিষ্যতে ত্বকীর সাথে আমার জীবনযাপনের আকাক্সক্ষায়, অথচ যা আর কোনোদিন হবার নয়। এইসব ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার জীবন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রক্ষার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের, সমাজের। ত্বকী তার একটি কবিতায় লিখেছিল, ‘সমগ্র মানবজাতি আজ এক কাতারে দাঁড়াবে,/ হিংসা বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে,/ জলাঞ্জলি দিয়ে হিসেব কষা,/ ছড়িয়ে দেবে ভালোবাসার গান-/ বলবে মানুষ চাই সমানে সমান।’ একটি সমতার সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল ত্বকী। কিন্তু কতটা বিরূদ্ধ সমাজে বসে সে এ স্বপ্ন দেখছে এধারণা হয়তো ওর ছিলনা।

ডাকঘর-এর কিশোর অমল দইওয়ালা হতে চেয়েছিল, হতে পারেনি। শৈশব-কৈশোরে বিচিত্র সব স্বপ্ন এসে ভিড় করে। ত্বকী শৈশবে আর্মি হতে চাইল। ওর মনে হয়েছিল এরা খুব সাহসী, দেশ-বিদেশে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ওর বাবা জলপাই ছাপের জ্যাকেট ও ট্রাউজার এনে দিয়েছিল। পেয়ে আনন্দ আর ধরে না। পরে প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিদায় নিল।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ পাঠাগার থেকে বই আনার পথে দুর্বৃত্তরা ত্বকীকে তুলে নিয়ে যায় শহরের পরিচিত আল্লামা ইকবাল রোডের টর্চারসেলে। সেখানেই নির্মমভাবে হত্যা করে সে রাতেই ঘাতকরা ত্বকীর লাশ ফেলে দেয় শীতলক্ষ্যা নদীর খালের পাড়ে। যে হত্যার সাড়ে সাতবছরেও অভিযোগ পত্র দেয়া হয়নি। তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত শেষ করে অভিযোগত্র তৈরী করে রাখলেও তা আদালতে পেশকরা হয় নি। বিচার শুরু হয় নি। আমাদের সংবিধানে যে কোন অপরাধের অভিযোগপত্র ৯০ দিনের মধ্যে দেয়ার একটি বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা এখন আর মানা হয় না। প্রতিনিয়ত সংবিধান লঙ্ঘনের অনিয়মই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এখানে অপরাধীরা প্রতিনিয়ত সরকারের প্রশ্রয় পায়। সবকিছু জানার পরেও রাষ্ট্র অপরাধীদের পক্ষ নেয়, হত্যাকারীদের পাশে দাঁড়ায়। আমরা কী এমনি স্বাধীন দেশ চেয়েছিলাম? এটাইকী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ?

এখন পরবর্তী প্রজন্মের অবস্থা এমন হয়েছে যে, ‘বালক জানে না কতটা হেঁটে এলে ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।’ যে কারণে ত্বকীরও আর পথ হাঁটা হলো না। নিখোঁজ হওয়ার পরদিন ওর এ-লেভেল পরীক্ষার প্রথম পর্বের ফল প্রকাশিত হলো। পদার্থবিজ্ঞানে বিশ্বের সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিল। ও-লেভেল পরীক্ষায় দেশের সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে ‘ডেইলি স্টার’ পুরস্কার নিতে গিয়ে পরিচিতি প্রকাশে জীবনের লক্ষ্য প্রকাশে লিখেছিল, ‘সততাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লালন করব।’ যে জীবনের পরিসীমা এতই ছোট যে আঠারোর আগেই পথ ছেড়ে চলেযেতে হয়, সেখানে লক্ষ্য যে মুখথুবরে পড়ে। তবে অবিচারই শেষ কথা নয়।

মানুষের ভেতরের অন্তর্গত শক্তিতে বিবেক আর চেতনার ঝড়ে আমাদের সন্তানেরা একদিন না একদিন মহৎ ব্রত নিয়ে এই দেশকে শিশুর বাসযোগ্য করে তুলবে। যেখানে বাস্তবায়িত হবে ত্বকীর স্বপ্ন। এখানে ত্বকীকে বাঁচতে দেয়া নাহলেও এই দেশ ত্বকীদেরই দেশ। এর গাছ-পালা, নদী-নালা, খাল-বিল এই শীতলক্ষ্যা নদীতে, মাটিতে ত্বকী মিশে আছে। বেঁচে থাকা ত্বকীদের জন্য আমাদের এই দেশ বাঁচবে, বেঁচে থাকবে। অবশ্যই বাঁচবে। আজ কিলবিল ঘাতকের শহরে ত্বকীর জন্মদিনে এ আমার বিশ্বাস।

রওনক রেহানা: তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর মা

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়