ত্বকী: বিচারহীনতার এক বেদনাক্লিষ্ট দৃষ্টান্ত
সুলতানা কামাল: কিছু কিছু মানুষকে হারানোর বেদনা, তার তীব্রতা যেন একটুও কমতে চায়না- সেই মানুষটি কাছেরই হোক কি দূরের, আত্মীয় কি অনাত্বীয়- তা যত পুরনোই হোক না কেন, বিশেষ করে সেই মানুষটি যদি হয় একটি নিষ্পাপ শিশু যাকে হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে। বরং যত দিন যায় সেই ব্যাথার সাথে হতাশা আর ক্ষোভ মিলেমিশে যন্ত্রণার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।
বিশেষতঃ যেহেতু সেই হারানোর ঘটনাটা ঘটেনি কোন স্বাভাবিক জৈবিক কারণে বা স্বাভাবিক নিয়মে। ঘটনাটা ঘটেছে কিছু দুর্দৃত্তের অপরাধ প্রবনতার কারণে। চিহ্নিত খুনীরা অপহরণ করে নৃশংসভাবে একটি নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করেছে কিন্তু সমাজের বিচারহীনতার সংস্কৃতির সুযোগ নিয়ে তারা এখনও দাপটের সংগে চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই শোকের কষ্ট শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এর বিচার না হওয়ার অনাচার। তাই আজকে আট বছর অতিবাহিত হওয়া সত্বেও ত্বকীর হত্যাকা-ের বেদনা একটুও ম্লান হয়ে যায়নি।
ত্বকীকে আমি কখনও দেখি নি। ওকে জানতে শুরু করেছি ওর চলে যাওয়ার পরে। আর যত জানছি ততই অবাক হয়েছি, ওকে হারানোর বেদনা ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। আজকে ত্বকীর চলে যাওয়ার দিনে ওকে স্মরণ করছি গভীর বেদনায়, পরম মমতায়।
আমার পেশাগত কারণে ত্বকীর বয়সী অনেক ছেলেমেয়ের সাথে যোগাযোগ ঘটে। ত্বকীর সাথে তেমন ভাবে কোন কারণে একসাথে কাজ করা হয়ে ওঠে নি। ওকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনারও সুযোগ হয় নি, যদিও ওর বাবা রফিউর রাব্বিকে পেয়েছি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সহকর্মী হিসাবে। তবে ওঁর লেখা পড়ে, ওঁর কথা শুনে, অন্যের মুখে ওঁর জীবনধারা সম্পর্কে জেনে ওঁর প্রতি আমার ভালবাসা অনেক গভীর হয়েছে। ত্বকীর মৃত্যুতে আমি পরিবারের সদস্য হারানোর বেদনায় আক্রান্ত বোধ করেছি। ত্বকীর উপর যে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে, শিউরে উঠেছি এই ভেবে যে, আহারে একটা শিশুকে কি যন্ত্রণাটাই না সহ্য করতে হয়েছে। সে নির্যাতন যেন ত্বকীর শরীর ছাপিয়ে আমাদের সবাইকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। আমরা ত্বকীকে রক্ষা করতে পারি নি। এখনও পারছিনা ত্বকীদের রক্ষা করতে এই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে মূলতঃ অপরাধের জন্য তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারিনি বলে, পারি না বলে। সমাজ হিসেবে এ ব্যার্থতায় লজ্জাবোধ করার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছি আমরা।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করি বলে প্রায়শই যাদের কোন না কোন অধিকার লংঘিত হয়েছে অথচ সেই অধিকার লংঘনের কোন বিচার পাচ্ছেন না, তাদের মুখামুখি হতে হয় আমাকে। বিচার না পাওয়া মানুষগুলোর দুঃখ, ক্ষোভ অনেকগুণ বেড়ে যায় যখন তারা দেখেন যে এর পিছনে রয়েছে সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসন এর অনীহা, অবহেলা- এমন কি কখনও কখনও আপাতঃ সম্মানিত প্রভাবশালী নেতাদের অন্যায় হস্তক্ষেপ। ত্বকী হত্যার বিচারের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে। কারণ এ হত্যাকা-ের বছর না যেতেই তদন্তকারী সংস্থা সংবাদ সম্মেলন করে এ হত্যার রহস্য উন্মোচনের দাবি করেছিল। তরা হত্যার কারণ, স্থান, সময় সহ ঘাতকদের নাম-পরিচয় পর্যন্ত প্রকাশ করেছিলেন। অথচ অভিযোগপত্র আদালত পর্যন্ত গড়ালো না।
যারা ত্বকীর হত্যাকা- নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা সকলেই প্রথম দিন থেকেই দেখে আসছেন যে যথেষ্ট দৃশ্যমান লক্ষণ থাকার পরেও ত্বকীর হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনার কাজটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে বছরের পর বছর। বরং এই বিষয়ে যতটা পারা যায় সুকৌশলে বিভ্রান্তি সৃষ্টিরও চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এখন এই বিচারিক প্রক্রিয়াকে একেবারেই স্থবির করে ফেলা হয়েছে। আট বছর অতিক্রান্ত হলো- ত্বকী হত্যার বিচারকার্য্য এখন আশ্চ্যর্যজনকভাবে থেমে আছে, এক বিন্দুও এগোচ্ছে না, এখন পুরোপুরি থমকে আছে। অথচ আমাদের দেশের পুলিশের ক্ষমতা, তৎপরতা ও দক্ষতা সম্পর্কে আমরা সম্যক অবগত আছি। আর তাই তাদের এ হেন অপারগতা ত্বকী হত্যা মামলা নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। মামলাটি আমাদের সমাজের বিচারহীনতার একটি বেদনাক্লিষ্ট দৃষ্টান্ত হয়ে আমাদের বুকের উপর চেপে বসে আছে। আমরা এ দুর্বিসহ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাই, ত্বকী হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে সমাজের ন্যায়নিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা দেখতে চাই।
লেখক: এড. সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কর্মী
প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম