২৯ মার্চ ২০২৪

প্রকাশিত: ১৭:২৯, ৪ মার্চ ২০২১

ত্বকীর জন্য এই অচলায়তন ভাঙ্গতে হবে

ত্বকীর জন্য এই অচলায়তন ভাঙ্গতে হবে

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে আমি কখনো দেখিনি, তার পরিবারের সঙ্গেও কোনো পরিচয় ছিল না। সে বড় হয়েছে নারায়ণগঞ্জে, যে শহরটি একসময় - ত্বকীর জন্মের বহু আগে- আমার খুব প্রিয় ছিল, নানান অনুষ্ঠানে কয়েক বার গিয়ে যার সাংস্কৃতিক জীবনকে ভালো লেগেছিল, যদিও একসময় কিছু সন্ত্রাসীর দখলে শহরটি চলে যাওয়ায় আর সেখানে যেতে ইচ্ছে হত না, এমনকি সুধীজন পাঠাগারের টানেও। কিন্তু অনেক বছর পর একটি স্তব্ধ করে দেয়া সংবাদ আমাকে আবার সেই শহরটিতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। সংবাদটি ত্বকীর নির্মম হত্যাকা-ের। এবং যে সন্ত্রাসীরা শহরটিকে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত করিয়েছিল সারা দেশে, ঘুরে-ফিরে তাদের নামই মিডিয়াতে উচ্চারিত হতে থাকল ত্বকীর হত্যাকারী হিসেবে। আমার মনে হয়েছে ত্বকীদের মতো রুচিশীল, সুস্থ এবং বাঙালি সংস্কৃতির মূল্যবোধে আস্থাশীল পরিবার থেকে উঠে আসা মেধাবী কিশোর-তরুণদের জন্য নারায়ণগঞ্জ বোধ করি এখন সবচেয়ে ভয়ানক একটি জায়গা। এই সন্ত্রাসী পরিম-লে ভুল সময়ে বেড়ে ওঠাই কি কারণ ছিল ত্বকীর এই অবিশ্বাস্য চলে যাওয়ার?

একটি সভ্য সমাজ কি এই হত্যাকান্ডের পর নিজেকে সভ্য দাবি করতে পারে? নাকি এ সমাজ এখনও তৈরি হয়নি ত্বকীর মতো সুন্দর একটি কিশোরকে জায়গা দেয়ার জন্য?

ত্বকীর ছবি দেখেছি পত্রপত্রিকায়, তার ছোট্ট জীবনের নানা ঘটনার বর্ণনা শুনেছি, তার লেখা ডায়েরির ছাপানো পাতা পড়েছি, তার ছোট ভাইটি এবং বাবা মায়ের সঙ্গে তার ছবির অ্যালবাম দেখেছি, আর চোখের পানি ফেলেছি। মনে হয়েছে, ত্বকীকে যেন কতকাল থেকে চিনি। কী মননশীল এবং প্রত্যয়ী একটি কিশোর, দেশকে নিয়ে, সমাজকে নিয়ে, মানুষকে নিয়ে কী সুন্দর তার ভাবনা! না জানি কত অমূল্য দানে ত্বকী সমৃদ্ধ করতে পারত দেশটাকে, স্পর্শ করতে পারত তার মতো স্বপ্ন দেখা আরো অসংখ্য কিশোরকে। কিন্তু বেছে বেছে এই মেধাবী আর অমিত সম্ভাবনাময় কিশোরটিকেই অন্ধকারের কিছু মানুষ বেছে নিল তাদের জিঘাংসা মেটাবার জন্য। তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, তারা অথবা তাদের ভয়ানক হয়ে বেড়ে ওঠা সন্তানেরা কি ত্বকীর ধারে কাছে আসার যোগ্যতা রাখে, নাকি তারা কোনোদিন ত্বকীর একটি গুণও অর্জন করতে পারবে? আমি জানি অনুশোচনা অথবা আত্মশুদ্ধি এদের অভিধানে কখনো জায়গা পায়নি। পেলে তো অনেক আগেই, ত্বকীকে অত্যাচার করার জন্য উত্তোলিত হাত তাদের কাঁপতো।

ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে এরপর। একজন ভাঙ্গাবুক অথচ দৃঢ়চেতা মানুষ এখন একটা সংগ্রামে নেমেছেন, ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে, ত্বকীর মতো আর কাউকে যেন সন্ত্রাসীরা তাদের শিকারে পরিণত করতে না পারে- সেই উদ্দেশ্যে। তিনি ত্বকী মঞ্চ তৈরি করেছেন। ত্বকী মঞ্চের কয়েকটি আলোচনা সভায় গিয়েছি। ক্ষোভের কথাগুলি বলেছি, কিন্তু এও বুঝতে পেরেছি, যে অন্ধকারের বিরুদ্ধে ত্বকী মঞ্চের সংগ্রাম, সেটি এমনই সর্বগ্রাসী যে এর বিপরীতে একটা নতুন সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষাতে কেটে যেতে পারে বহু মাস বছর। অবাক হয়ে দেখেছি, হত্যাকারী কে বা কারা, হত্যাকা- কোথায় হয়েছিল, কখন হয়েছিল- সেসব বিষয় স্পষ্ট হলেও আইনের হাতটা অপরাধীদের দিকে অগ্রসরই হতে পারছে না। রাষ্ট্র নির্লিপ্ত, দল সন্ত্রাসীদের পক্ষে। এ অবস্থায় চোখ ঢাকা আইনের প্রতিমা কাঁদতেই পারেন শুধু। কিন্তু অন্ধকারের অচলায়তন তো ভাঙতে হবে। তা না হলে ত্বকীদের আমরা চিরতরের জন্য হারাবো।

ত্বকীর ছবির দিকে যতবার তাকাই, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে দেখি আমি, যে বাংলাদেশ আত্মবিশ্বাসী, মেধা ও মননে সমৃদ্ধ এবং অসম্ভবের স্বপ্নে বিভোর। ত্বকীও স্বপ্ন দেখত, তার স্বপ্নে ছিল দেশ। এখন দেশটা স্বপ্ন দেখবে তাকে নিয়ে, কিভাবে তাকে বুকে ধারণ করে তারই দেখানো পথে তা অগ্রসর হবে।

ত্বকী সম্পর্কে টুকরো টুকরো কথা, তাকে নিয়ে তার মার স্মৃতিচারণ, তার বন্ধুদের নানা ঘটনার বর্ণনা থেকে তার একটা যে প্রোফাইল আমি সাজাতে পেরেছি, তাতে একদিকে একটা গৌরবের ছবি, অন্যদিকে বেদনার একটা ছায়া। গৌরবটা ত্বকীর নানা অর্জনের, ত্বকীর ত্বকী হয়ে ওঠার; বেদনাটা তাকে অকালে হারানোর। ত্বকীর খুনিরা শুধু তাকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়নি, একই সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে মানুষের ওপর মানুষের বিশ্বাসকে, শ্রেয়বোধ এবং সত্যের ও সুন্দরের প্রতি আস্থাকে। এসবকে ফিরিয়ে আনতে হবে, এবং এজন্য প্রয়োজন ত্বকীর সৌরভ সবখানে ছড়িয়ে দেয়া। ত্বকী মঞ্চ কাজটি করে যাচ্ছে, কিন্তু কাজে নামতে হবে আমাদের সকলকেই।

আমি বিশ্বাস করি, তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী চলে গেলেও সে আছে, সবখানেই আছে। শুধু মায়ের অস্তিত্বজুড়ে নয়, বাবার ভালোবাসাতে নয়, ব্যথাতুর বন্ধুদের স্মৃতিতে নয়, সে আছে প্রতিটি বিবেকবান মানুষের মনের ভেতরে, প্রতিটি শ্রেয়বোধসম্পন্ন মানুষের চিন্তায়। ত্বকী এখন একটি আদর্শের নাম, একটি অনুপ্রেরণার নাম, যা বাংলাদেশকে আলোকিত করবে, অচলায়তন ভাঙার উৎসাহ ও বিশ্বাস জোগাবে।

আজ ত্বকীকে হত্যার ৮ বছর। আমারা একবার তাকে হারিয়েছি। কিন্তু তার কথা ভেবে যদি আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াই, সন্ত্রাস এবং অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াই- এবং সকলে মিলে দাঁড়ালে আমরা জয়ী হবই- ত্বকীকে তখন আর হারাতে হবে না।

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: শিক্ষাবিদ, লেখক

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়