২৯ মার্চ ২০২৪

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ২৪ জানুয়ারি ২০২০

দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে!

দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে!

রণজিৎ মোদক: মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও নাট্যকার তথা বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি, প্রথম স্বার্থক নাট্যকার। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার পথ নির্মাতা। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯৬তম জন্মবার্ষিকী আজ।

মাইকেলের জীবন ছিল নাটকীয় ঘটনায় ভরা। বিগত শতকের গবেষকরাই বলে গেছেন, তার সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের যোগসূত্র সৃষ্টিতে সফল। তার রচনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রথম সম্মিলন ঘটেছে। এ ব্যাপারে বলা হয়, ‘যে বাংলা কাব্য যেন ছিল নারীধর্মাশ্রিত, মধুসূদন তাকে দান করেছেন গুরুগাম্ভীর্য এবং পৌরুষ। বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিকতার ধারাকে তিনি স্বাধীন চিন্তার পথে প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন।’

মাইকেলের জন্ম ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে। মাতা জাহ্নবী ও পিতা রাজনারায়ণ দত্ত। পিতা সেকালের রীতি অনুযায়ী ফার্সি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। কলকাতা সদর দেওয়ানী আদালতের ব্যবহারজীবী হিসাবে তিনি শুধু প্রতিষ্ঠিতই হননি, প্রচুর অর্থও উপার্জন করেছিলেন। মধুসূদন শৈশবে গ্রামের পাঠশালায় শিক্ষা আরম্ভ করেন। পরে ১৮৩৩ সালে কলকাতায় গিয়ে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন।

পাশ্চাত্য জীবনের প্রতি প্রবল আকর্ষণে তিনি হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করার পর তার পিতা রাজনারায়ণ দত্ত তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেন এবং তার মায়ের মৃত লাশটি পর্যন্ত তাকে দেখতে দেওয়া হয়নি। ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজ চলে যান। সেখানকার সাত বছর প্রবাসকালে শিক্ষক, সাংবাদিক ও কবি হিসেবে সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। মাদ্রাজ যাবার পরেই তিনি ইংরেজ রমণী রেবেকা ম্যাক্টাভিসকে বিয়ে করেন। ১৮৪৯ সালে রচনা করেন ইংরেজী কাব্য ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’। বইটি প্রকাশ হওয়ার পর তার পিতা তাদের নায়েবকে দিয়ে ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ বইটি সংগ্রহ করেন। তৎকালীন সময়ে ১০ টাকা দিয়ে নায়েব বইটি বাধিয়ে আনেন। ১০টাকা দিয়ে বইটি বাধিয়ে আনার কারণে তাকে তিরস্কার করেন রাজনারায়ণ দত্ত। নায়েব এর উদ্দেশ্যে রাজ নারায়ণ দত্ত বলেন, ‘আমার সিন্দুকে কি স্বর্ণ ছিল না? প্রয়োজনে বইটি স্বর্ণ দিয়ে বাধিয়ে আনতেন।’ ১৮৫৬ সালে কবি রেবেকাকে ত্যাগ করে এক ফরাসী মহিলা হেনরিয়েটাকে বিয়ে করে কলকাতায় ফিরে আসেন।

গবেষকরা বলেন, এরপরই তার রচনার স্বর্ণকালের সূচনা হয়। কলকাতায় এসে পুলিশ কোর্টে কেরাণী ও পরে দোভাষী হিসেবে কাজ করেন। ১৮৫৮ সালে রচনা করেন নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। ১৮৬০ সালে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামক দুটি প্রহসন লেখেন। সেই বছরেই সবপ্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। এরপর ১৮৬১ তে রচনা করেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। বিপুলভাবে বন্দিত এবং তীব্রভাবে নিন্দিত এই মহাকাব্য বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্মরণীয়তম রচনা। এরপর লেখেন ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬২) যা তার রচনার মধ্যে অন্যতম।

১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্র তার যুগান্তকারী নাটক নীলদর্পণ রচনা করেন। রেভারে- জেমস লং তা ইংরেজীতে অনুবাদ করিয়ে প্রকাশ করেন। তার জন্য তাকে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ সেই জরিমানার টাকা দিয়ে দেন। কিন্তু নাটকটির অনুবাদক ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত ‘রায় বাহাদুর দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুরের জীবনী’ প্রবন্ধে লিখে গেছেন ।

১৮৬২ সালে কবি ইউরোপ যাত্রা করেন এবং চার বছর পরে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরেন। ১৮৬৩ সালে তিনি ফ্রান্সে গিয়ে ভার্সাই নগরে সপরিবারে থাকতে শুরু করেন। এই সময় তার তীব্র অর্থাভাব দেখা দেয় এবং ঋণের দায়ে জেলে যাবার দশা হলে, তার লেখা চিঠি পেয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দেড় হাজার টাকা পাঠিয়ে এবং পরে আরো টাকা সংগ্রহ করে পাঠিয়ে, কবিকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। তখন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে চিঠি লেখেন এবং সেই চিঠিতে বলেন- আপনি শুধু বিদ্যার সাগরই নন, আপনি দয়ারও সাগর। ওদিকে ভার্সাইতে থাকাকালীন কবি ইতালীয় ভাষার সনেট বাংলায় প্রবর্তনের চেষ্টা করেন, যার ফল তার চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৮৬৬)। পরবর্তীতে ভার্সাই থেকে মাইকেলকে কলকাতা নিয়ে আসেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর ভেবেছিলেন কবিকে তিনি কাছে রাখবেন। কিন্তু তা কি আর হয়! দাম্ভিক কবি মাইকেল নিজে বাসা ভাড়া করে বসবাস শুরু করেন।

মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্রের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আইন ব্যবসায় তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেননি। তাছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য তিনি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে অর্থাভাবে তিনি মারা যান। যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামের কিছু যুবক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে কবির সমাধি নির্মাণের জন্য সাহায্যের কথা বলেন। তখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘জীবিতকালে যাকে সাহায্য করতে পারিনি, মৃত্যুর পর তার সমাধি নির্মাণে কী সাহায্য করবো!’ এই বলে যুবকদের বিদায় দিয়ে নিরবে কেঁদেছিলেন বিদ্যাসাগর। মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিতে আজও লেখা তারই কবিতা-

‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব

বঙ্গে! তিষ্ট ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে...

লেখক: রণজিৎ মোদক

শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়