২০ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২২:২৩, ২৫ জানুয়ারি ২০২২

আপডেট: ১৫:৩০, ২৬ জানুয়ারি ২০২২

নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের পাওয়ার হাউজ ‘চুনকা কুটির’

নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের পাওয়ার হাউজ ‘চুনকা কুটির’

প্রেস নারায়ণগঞ্জ: টানা তৃতীয়বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে এই শহরে নিজের জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক দক্ষতা; উভয়ের প্রমাণ দিয়েছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। ক্ষমতাসীন দলের জেলা কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হলেও তার পক্ষে কথা বলতে ভয় পেতেন অনেকেই। অথচ সেই প্রেক্ষাপট বদলে গেছে এই নির্বাচনে। নারায়ণগঞ্জ শহরের বাইরের উপজেলা ও থানা কমিটির নেতারাও এখন ভিড় করছেন আইভীর বাড়ি ‘চুনকা কুটিরে’। নগরীর দেওভোগের ‘চুনকা কুটির’কে এখন আওয়ামী লীগের পাওয়ার হাউজ বলা হয়। আইভীকে কেন্দ্র করেই নেতা-কর্মীরা চাঙ্গা হচ্ছেন। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি আইভীকে সামনে রেখেই গঠন করতে চাচ্ছে দলের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকরাও।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন থেকেই এই শহরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উত্তর-দক্ষিণের বিভাজন। দলীয় নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে আসছেন সাংসদ শামীম ওসমান। তবে এই শহরে প্রতিবাদী ও সৎ ইমেজের মধ্য দিয়ে আরেকটি অংশের নেতা-কর্মীদের মাঝে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছিলেন আইভী।

জানা যায়, ২০০১ সালে বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর দেশ ছাড়েন শামীম ওসমান। সেই সময় নারায়ণগঞ্জ শহরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সংকট দেখা দেয়। কয়েকজন নেতা আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনে চেষ্টা চালান। ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে চেয়ারম্যান প্রার্থী করে দল। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রি নেওয়া আইভী বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থীকে হারান। স্থানীয় সরকারের চেয়ারে বসা আইভীকে ঘিরে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। আইভীর পিতা প্রয়াত পৌরপিতা আলী আহাম্মদ চুনকা যেমন কর্মীবান্ধব নেতা ছিলেন তেমনি তাঁর কন্যাও নেতা-কর্মীদের মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে সকলের মাঝে আলাদা অবস্থান তৈরি করেন।

এক-এগারোর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর দেশে ফেরেন শামীম ওসমান। এরপরই শুরু হয় আইভী-শামীমের নেতৃত্বের লড়াই। তাদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনে। সেইবার আইভীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হন শামীম ওসমান। তবে হারেন বিপুল ভোটের ব্যবধানে। স্থানীয় রাজনীতিকদের ভাষ্য, এই হারের গ্লানি ভুলতে পারেননি শামীম ওসমান। ফলে আইভীর বিরুদ্ধে তার অবস্থান থেকে এতটুকুও সরেননি তিনি। যার প্রতিফলন সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচনেও দেখা গেছে। তবে গত দুই নির্বাচনের মতো এবারও শামীম ওসমান কিংবা তার অনুসারীদের সহযোগিতা ছাড়াই বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন আইভী। এতে তার জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণ হয়েছে সকলের মাঝে।

এদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আইভীর এই পথচলা সহজ ছিল না। এই শহরের অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে তাকে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, খুনি, ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বজায় রাখতে গিয়ে মৃত্যুর কাছাকাছিও যেতে হয়েছে তাকে। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে চাষাঢ়ায় তাকে হত্যা চেষ্টাও করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে আইভী একাধিকবার বলেছেন, মৃত্যুর মুখ থেকে উঠে এসেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, আইভীর চরিত্র হননের চেষ্টাও করা হয়েছে। তার বিকৃত চিত্রের পোস্টার সাঁটানো হয়েছে জেলার বিভিন্ন স্থানে। সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচনের পূর্বেও তার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালিয়েছে প্রতিপক্ষরা। তবে ধৈর্য ধরে ছিলেন আইভী। এখন সেই ধৈর্যের ফল পাচ্ছেন বলে মত অনেকের।

তাছাড়া রাজনৈতিক সূত্র বলছে, দীর্ঘদিনের নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি শামীম ওসমানে ক্ষুব্দ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাও। তাদের ভাষ্যমতে, শামীম ওসমান নিজেকে আওয়ামী পরিবারের দাবি করলেও তার দুই বড় ভাই করেছেন জাতীয় পার্টির রাজনীতি। মেজো ভাই সেলিম ওসমান এখনও জাতীয় পার্টির থেকে সংসদ সদস্য। বিগত ইউপি নির্বাচনে সদর ও বন্দর উপজেলায় শামীম ও সেলিম ওসমানের অবস্থানের কারণে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ক্ষুব্দ। অভিযোগ রয়েছে, শামীম ওসমানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে আওয়ামী লীগের লোকজনকে হারিয়ে ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান হয়েছেন বিএনপি, হেফাজত ও জাতীয় পার্টির নেতারা। এসব আওয়ামী লীগ নেতারা আইভীর বলয়ে যাওয়ার চিন্তা করছেন। এদিকে সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে শামীম ওসমানের অবস্থান নিয়ে কেন্দ্র পর্যন্ত চরম ক্ষুব্দ। কেবলমাত্র ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে শেখ হাসিনার ঘোষিত নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি ও তার অনুসারীরা। এই নির্বাচনে শামীম ওসমানের কর্মকান্ড দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার কান পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র।

এবারের নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কেবল ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর জয়ই নয় পরিবর্তন এনেছে স্থানীয় রাজনীতিতেও। নৌকার প্রার্থী হলেও যেই আইভীর পক্ষে ভোট চাইতে ভয় পেতেন খোদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই, সেই আইভীকে সামনে রেখেই এখন এগোতে চাচ্ছে দল। দীর্ঘ ১৮ বছরের নগরের প্রতিনিধি এমনকি নিজ দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেও কোনঠাসা আইভী এখন নেতা-কর্মীদের সাহস। শহর ছাড়াও জেলার অন্যান্য উপজেলার নেতা-কর্মীরা আইভীর বলয়ে চলে এসেছেন। সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের একাধিক সহযোগী সংগঠন ভেঙে দিয়েছে কেন্দ্র। এইসব কমিটিতে শামীম ওসমানের অনুসারীরা নেতৃত্বে ছিল। জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগেও আসছে বড় পরিবর্তন। আইভীকে সামনে রেখেই এইসব কমিটি ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। এতে লাভবান হবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও গণমানুষের রাজনীতি। রাজনীতি মানে উন্নয়ন, রাজনীতি মানে শান্তি; এই উক্তির প্রতিফলন ঘটতে যাচ্ছে আইভীর হাত ধরে। এমনটাই মনে করেন স্থানীয়রা।

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়