২০ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২০:১১, ১৩ মার্চ ২০২২

আপডেট: ২০:১১, ১৩ মার্চ ২০২২

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ হোক

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ হোক

রণজিৎ মোদক: প্রতিটি উৎসবকে সামনে রেখে দেশের একশ্রেণীর ব্যবসায়ী মহল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ফন্দি আটে। সামনে রমজান মাস তাই এখনই বাজারে সর্বোচ্চ নিত্যপণ্য দ্রব্যসহ সর্বত্র আগুনের বাতাস বইছে। চাল, ডাল, তেল ও মাছ-মাংস সহ নিত্যপণ্যের দাম প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাজার তদারকি ও মনিটরিংয়ের অভাবেই এই অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি করছে- এমন অভিযোগ ভোক্তাদের। ইতিমধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মূল্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। দফায় দফায় সব প্রয়োজনীয় মূল্যবৃদ্ধির ফলে, নিম্নমধ্যবিত্তদের আরো অধিক বিপদের দিকে ঠেলে দেয়ার আশঙ্কা সংল্লিষ্টদের।

বিভিন্ন দেশে উচ্চমাধ্যমিক লক্ষ্যে বিভিন্ন পণ্য দ্রব্যের মূল্য হ্রাস করা হয় হজ্বযাত্রীদের মুখে শোনা, আমার বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব এবং হাজ্বীদের মুখে শুনেছি, হাজ্বীদের সেবা যতেœর জন্য বিভিন্ন কোম্পানি ও ধর্নাঢ্য পরিবার বিনামূল্যে সেবাদান করেন। বিভিন্ন খাবার পানীয় পরিবেশন করে থাকেন। অথচ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের রক্তচোষার জন্য বিভিন্ন কৌশলে নিত্যপণ্য সহ সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি করছে। একদিকে করোনা অপরদিকে ইউক্রেনের-রুশ সামরিক অভিযান। শুধু তাই নয় ভারত বাংলাদেশের বর্ডারকে যেন যেকোনো কারণে ২-১ দিন বন্ধ থাকলে চাল-ডালের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ যেন বলির পাঠা-কোরবানির গরু। হাত-পা যার বাধা নীরবে মার খাওয়া ছাড়া আর কি গতি আছে গোলাম হোসেন?

করণা ঝড়ের পর বর্তমানে একটি শিল্প আবাসিক এলাকার বসত বাড়ির ভাড়াটিয়া পরিবারদের করুণ চিত্র সংবাদ জানালাম স্থানীয় বন্ধুর মুখে। তাদের মহল্লায় ১৮০ টি ভাড়াটিয়া পরিবার বাস করতেন। এসব প্রত্যেকটি ভাড়াটে পরিবার বিভিন্ন মিল-কারখানায় কাজ করতেন। বর্তমানে সেই মহল্লায় ১০০ পরিবার বাসাবাড়ি থেকে চলে গেছে। বাসাবাড়ির সুবিধা চাকরীচ্যুত কারণেই হোক অনেকে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। বাসা ভাড়া বৃদ্ধি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবিত সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। ২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যায়ক্রমে মূল্যবৃদ্ধির চাবুকের ঘায়ে এমনিতেই মানুষ দিশেহারা। বোঝার উপর শাকের আটি। কত যে ভাড় তা ভাড়বাহী নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষই বুঝেন।

রাজধানীর পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজার থেকে শুরু করে তেজগাঁও এমনকি নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ-বন্দর সর্বত্র কাঁচা তরিতরকারির জন্য বিখ্যাত। গ্রাম থেকে শহরে এসব পণ্য আমদানি করা হলে দ্বিগুণ-তিনগুণ মূল্যবৃদ্ধিতে বিক্রি করা হচ্ছে। আমতলায় আমের মূল্য অধিক এই প্রবাদ মুখস্থ হয়ে গেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে খাদ্য নিত্যপণ্যের দাম। অভিযোগ রয়েছে, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে এভাবে বাজারদর নিয়ন্ত্রণহীন করছে। ভোক্তা ক্রেতাদের অভিযোগ সরকারের বাজার মনিটরিং সিস্টেম পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে আছে। সর্ষের মধ্যে ভূত রয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিদিন ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রকাশ করেন। ২০০৯ সালের নভেম্বরে ঢাকার বাজারে এক কেজি সরু বোরো চালের দাম ছিল ৩৪-৩৬ টাকা। ২০২১ সালে একই বাজারে ওই চালের দাম ছিল ৫৭-৫৮ টাকা। আর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ওই চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকা। মোটা চালের কেজি ২১-২৩ টাকা। ২০২১ সালে ছিল ৪০-৪৫ টাকা। আর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ৪৮-৫০ টাকা। ২০০৯ সালে এক কেজি দেশি মসুর ডালের দাম ছিল ৭৫-৮০ টাকা। ২০২১ সালে ৯০-১০০ টাকা। ২০০৯ সালে মুগ ডালের কেজি ছিল ৮০-৮৫ টাকা। ২০২১ সালে সেটি বেড়ে হয় ১০০ ১১০ টাকা। ২০২২ সালের ৪ মার্চ তা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩০ টাকা। স্থান বিশেষ আরো বেশি। ২০০৯ সালে আটার কেজি ছিল ২৫-২৬ টাকা। ২০২১ সালে ৩৫-৩৬ টাকা। ময়দা ২০০৯ সালে ৩৪-৩৬ টাকা। ২০২১ সালে ৪৫-৫০ টাকা। বর্তমানে প্যাকেট লাল আটা বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকা কেজি। সয়াবিন লিটার ৭০-৭২ টাকা। ২০২১ সালে ১৩৮-১৪২ টাকা। চলতি সনের ফেব্রয়ারি-মার্চে বিক্রি হচ্ছে ১৮০-১৯৫ টাকা। স্থান বিশেষ আরো অধিক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। ডিম মাংসের বাজার ২০০৯ সালের দ্বিগুণ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে পিয়াজ, রসুন ও কাঁচা মরিচের বাজার নিয়ে অনেক নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। এদেশে ঘটনার চেয়ে রটনায় প্রভাবিত মানুষ। দেশে অভাবের সূত্র কি বুঝা মুশকিল। টাকা থাকলে সব মিলে তবে অভাব কিছু। স্বভাবের পরিবর্তন না হলে অভাব কোনদিনই দূর হবে না। আমরা নিজেদেরকে ধার্মিক পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। সেবাই পরম ধমর্। মানবতা মানব সেবাই উত্তম। এসব কথাগুলো শুধু প্রার্থনালয় এর মধ্যেই রাখলে চলবে না, বাস্তবতার আলোকে উদ্ভাসিত হোক।

রাজধানীর ঢাকা শহরে বড় বড় চাকরীজীবি ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের কর্মস্থল। এখানে সিটি মেয়রের অনুমোদনে টয়লেটে ব্যবসাও জমজমাট চলছে। মাথাপ্রতি ৫-১০ টাকা করে নিচ্ছে। অপরদিকে গত ১২ বছরের ১৪ বার পানি দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা। গত ২০০৯ সালে গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট ১০০০ লিটার পানির দাম ছিল ৬ টাকা ৭৫ পয়সা। গত ২০২১ জুলাই থেকে ১৫ টাকা ১৮ পয়সায় দিতে হচ্ছে। গত ১১ বছরে বিদ্যুতের দাম ১০ বার বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করার সাথে সাথে বাস, লঞ্চ মালিক পক্ষ তাদের ভাড়া বাড়িয়ে যাত্রীদের পকেট কাটছে। ১২ কেজি সিলিন্ডার গ্যাস ৫৪ টাকা বেড়েছে। এসব কিছুর চাপ পড়ছে সাধারণ জনগণের উপর। সরকার বর্তমানে জনগণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাকালীন বহু মানুষ বেকার হয়েছে। অনেক মিল কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে ইউক্রেন-রুশ যুদ্ধ, সামনে আসছে পবিত্র মাহে রমজান মাস। রমজান মাসকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওৎ পেতে আছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, চাহিদার তুলনায় বেশি কোন অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ দেওয়া হবে না। কৃত্রিম উপায়ে পণ্যের সংকট সৃষ্টি করে মূল্যবৃদ্ধির চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যবস্থা নেওয়া হবে এতো ভবিষ্যতের কথা। বর্তমানে সমস্যা যাতে সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন সেটাই দেখার বিষয়! ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যায়। সে হবে দুঃখের বিষয়। ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ সর্বত্র। করোনার সময় দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বলে জরিপ সূত্রে জানা গেছে। বর্তমান সরকারের বহুমুখী উন্নয়ন আজ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। সেইসব উন্নয়নের চিত্রপট যাতে ম্লান যাতে না হয়। সেটাই স্বাধীনতার পক্ষের সবার প্রত্যাশা।

এ করোনাকালীন দুঃসময় ভর্তুকি দিয়ে হলেও গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি তেল এবং ভোগ্য পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রেখে ক্ষেত্রবিশেষ দূর্নীতি-অনিয়ম, অব্যবস্থা, অপচয় বন্ধ করা জরুরী। অর্থনীতিবিদদের মতে, তাহলে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে না। যারা বলছেন, মানুষের ক্রয় ক্ষমতার দ্বিগুণ-তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে আসলে এ কথা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। গ্রামের মাটি-মাখা মানুষগুলো আর শহরের কোর্ট পরা জীবন যাত্রা এক নয়। সামনে পবিত্র রমজান ব্যবসায়ী মহল মানুষের ভাগ্য নিয়ে সুযোগ বুঝে রক্ত চুষে নেওয়ার জন্য ওৎ পেতে আছে। সাধারণ মানুষের কথা ভেবে নিত্যপণ্যের দাম আর না বাড়ানোই উচিত।

লেখক: রণজিৎ মোদক (শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট)

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়