২৩ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ১৭:০৮, ৮ মে ২০২১

আপডেট: ১৩:৪৫, ৯ মে ২০২১

পুনর্বাসন চায় কুমুদিনীর শ্রমিকরা (ভিডিওসহ)

পুনর্বাসন চায় কুমুদিনীর শ্রমিকরা (ভিডিওসহ)

প্রেস নারায়ণগঞ্জ: সত্তরোর্ধ্ব জয়নাল হাওলাদার। জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় পার করেছেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বিডি) লিমিটেডের পাট কারখানায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে বাবার সাথে এসেছিলেন। তার সাথেই কাজ শুরু করেন। থাকেন শহরের ঈশা খাঁ সড়কের উত্তর কুমুদিনী বাগানে। তবে এই আবাসস্থল বেশিদিন টিকছে না। এই বাগানে প্রস্তাবিত কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ ও ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণ করা হবে। ফলে এই স্থান ছাড়তে হবে তাদের।

এক সময় পাই (এক আনার ১২ ভাগের এক পাই) হিসেবে পাটের বোঝা টানতেন জয়নাল। ১০০ বোঝা টেনে পেতেন চার টাকা। বর্তমানে ৫০ কেজির বোঝা টানলে পান ছয় টাকা। বয়সের কারণে সর্বোচ্চ ৪০টা বোঝা টানতে পারেন। চার ছেলে ও এক মেয়ের জামাইও এই কারখানার শ্রমিক। সব মিলিয়ে কষ্টে-সৃষ্টে দিন যাচ্ছিল জয়নালের পরিবারের। তবে উচ্ছেদের কথা শুনে তাদের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়েছে। কোথায় যাবেন কীভাবে থাকবেন তা নিয়ে চিন্তিত বৃদ্ধ জয়নাল। তিনি বলেন, ‘জীবনের ৫০ বছর এইখানে খোয়াইয়া দিছি। পোলাপানরা সব লেবার, আমিও লেবার। লেখা জানি না, পড়া জানি না। আইজও মরা লাগবে, কাইলও মরা লাগবো। উচ্ছেদ কইরা দিলে রাস্তায় গিয়ে মরা ছাড়া আর কোনো পথ নাই।’

একই অবস্থা এই বাগানের প্রায় আড়াইশ’ শ্রমিক পরিবারের। বাগানের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই পরিবারগুলোর অন্তত একজন সদস্য কুমুদিনী ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বিডি) লিমিটেডের পাট কারখানার শ্রমিক। তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মও কাজ করেছেন এই কারখানায়। বর্তমানে কারও কারও তৃতীয় প্রজন্মও এই কারখানার শ্রমিক। কেউ বোঝা টানেন, কেউ আবার খালাসি, পাল্লা মাপেন, লোড আনলোড, গাড়ি ঠেলা ও গোডাউন থেকে বিভিন্ন স্থানে রপ্তানির কাজেও নিয়োজিত আছেন। দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন তারা। মালিকপক্ষের অনুমতি নিয়ে নিজ অর্থ ও শ্রম দিয়ে কাঁচা ও সেমিপাকা ঘর তুলে এই শ্রমিকরা থাকেন উত্তর কুমুদিনী বাগানে।

শ্রমিকরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জে কুমুদিনী ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স এন্ড ক্যান্সার রিসার্চ (কেআইআইএমএস কেয়ার) স্থাপন করা হবে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। এই প্রকল্পের আওতাধীন ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণের জন্য ঈশা খাঁ সড়কের নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যা হাসপাতালের পাশের উত্তর কুমুদিনী বাগানের জায়গা নেওয়া হবে। এজন্য আগামী ৩০ মে এর মধ্যে বাগানের বাসিন্দাদের ঘর ছেড়ে দিতে বলেছে মালিকপক্ষ। সরেজমিনে দেখা যায়, উত্তর কুমুদিনী বাগানের সামনে কেআইআইএমএস কেয়ারের ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণের বিষয়টি উল্লেখ করে একটি বড় ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। বাগানের ঘরগুলোতে লাল চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকরা জানান, লাল চিহ্ন দেওয়া হয়েছে অন্তত আড়াইশ’ ঘরের সামনে। চিহ্নিত ঘরগুলো ছেড়ে না দিলে উচ্ছেদ করা হবে। শ্রমিকরা ছাড়া কয়েকটি বিহারি পরিবারও থাকে এই বাগানে।

এই বাগানের বাসিন্দা মো. জুয়েল (৩৩)। বেঙ্গল বিডির পাট কারখানায় খালাসি হিসেবে কাজ করেন তিনি। জুয়েলের বাবা আনোয়ার খান ও দাদা চান্দু খানও ছিলেন এই কারখানার শ্রমিক। স্বাধীনতার পূর্বে পরিবার নিয়ে বরিশাল থেকে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন চান্দু খান। গ্রামের বাড়িতে কোনো জায়গা-জমি নেই বলে কুমুদিনী ট্রাস্টের মালিকানাধীন জমিতেই ঘর তুলে থাকা শুরু করেন। দাদা ও বাবা গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর। সেই ঘরে মা, তিন ভাই, স্ত্রী ও শিশু কন্যাকে নিয়ে থাকেন জুয়েল।

তিনি বলেন, ‘গতর খাটাইয়া বাঁইচা আছি। পাটের ৫২০ বেল ফালাতে পারলে ৬৮৭ টাকা পাই। সারাবছর কাজ থাকে না। কাজ না থাকলে ভাড়ায় রিকশা চালাই। মাস শেষে ঘর ভাড়ার চিন্তা করা লাগে না বইলা কোনোরকম দিন যায়। এখন উচ্ছেদ কইরা দিলে আমাদের কোনো ঠাঁই নাই।’ বছর দেড়েক পূর্বে কিস্তিতে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ঘরের দেয়াল পাকা করেছিলেন জুয়েল। সেই কিস্তি এখনও অর্ধেক বাকি আছে। জুয়েল বলেন, ‘এই মুহুর্তে উচ্ছেদ হলে বাঁচার কোনো উপায় নেই। বাপ-দাদা এই কারখানার শ্রমিক ছিল। সেই বিবেচনা কইরাও আমাদের অন্তত অন্য কোথাও জায়গা দিক। তাদের তো আর জায়গার অভাব নাই। আমরা তো তাগোই শ্রমিক।’

গত শুক্রবার সকাল ১১টায় শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে একটি ব্যানার সাঁটিয়ে তার সামনে প্রতিবাদী সমাবেশ করেন কুমুদিনীর শ্রমিকরা। সেখানে উপস্থিত শ্রমিকরা বলেন, তাদের বাগান থেকে উচ্ছেদ করতে হলে শ্রম আইন অনুযায়ী প্রাপ্য পাওনা পরিশোধ করতে হবে। অথবা শ্রমিকদের বাসস্থানের জন্য অন্যত্র পুনর্বাসন করতে হবে। সমাবেশে উপস্থিত জয়নাল হাওলাদার বলেন, ‘রাজীব বাবু (কুমুদিনী ট্রাস্টের এমডি) যেন আমাগো একটু দয়া করে। এতদিন রাখছেন আর রাখতে পারবেন না, এমনটা যদি বলেন তাইলে শীতলক্ষ্যায় ভাইসা মরা ছাড়া আর কিছু করার না।’

কুমুদিনীর কারখানায় বোঝা টানে নুরুন্নাহারের (৩৫) দুই ছেলে। নিজে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন অন্যের বাসাবাড়িতে। তিনি বলেন, ‘জায়গা-জমি না থাকুক বাসা ভাড়া দিয়া থাকার মতোও যদি সামর্থ্য থাকতো তাইলে চইলা যাইতাম।’ আমেনা বেগম (৬০) বলেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেইকা আমরা এইখানে কাজ করি, এইখানে থাকি। আমার বাবা ও স্বামী এইখানে কাজ কইরাই মারা গেছে। আমি নিজেও কুমুদিনীর ভেতরে ঝাড়–র কাজ করছি। এখন আমাগো যাইতে বলতেছে। আমাগো একটু ঠাঁই না দিলে আমরা কই যামু?’

প্রাপ্য পাওনা পরিশোধ অথবা পুনর্বাসনের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি ও মালিকপক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে শ্রমিকরা। এতে শ্রমিকরা উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা শ্রমিকগণ দীর্ঘ ৩০/৪০ বছর হতে কম-বেশি বিভিন্ন মেয়াদে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অন্তর্ভূক্ত বেঙ্গল (বিডি) লিমিটেড কারখানায় চাকরি করছি। বেঙ্গল বিডি লিমিটেড একটি লাভজনক পাটজাত শিল্প কারখানা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যাহার শ্রমিকগণ বাংলাদেশ শ্রম আইন দ্বারা পরিচালিত এবং এই আইনের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী। অত্র আইনের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো শ্রমিকের চাকুরির অবসান করলে প্রাপ্য পাওনাদি পরিশোধ করা কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। এছাড়াও এই আইনের ধারা ৩২ এর উপধারা ধারা (২) এ উল্লেখিত আছে শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ না করে কোনো শ্রমিককে বাসস্থান হতে উচ্ছেদ করা যাবে না।’

শ্রমিকদের পক্ষে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিক নেতা অ্যাড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইল। তিনি বলেন, ‘এই শ্রমিকদের বাবা-দাদারাও এইখানে কাজ করেছেন। সেই সূত্রে তারা এখানে বসবাস করে কাজ করছে। শ্রম আইনের ৩২ ধারায় উচ্ছেদের পূর্বে পাওনাদি পরিশোধের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। হাসপাতাল বা নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণ করা মানবিক। কিন্তু শ্রমিকদের সাথে উচ্ছেদ করার মতো অমানবিক আচরণ করে মানবিক কাজ হয় না। শ্রমিকদের প্রাপ্য পাওনা বলতে গ্রাচ্যুয়িটি, চাকরির ক্ষতিপূরণ, অর্জিত ছুটির টাকা ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিষয়টিও আছে। আমি এসব পাওনাদি পরিশোধের দাবি জানাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘শ্রমিকদের কোনো সঞ্চয় নাই। তাছাড়া এই কোভিডকালীন পরিস্থিতিতে অন্য কোথায়ও বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার মতো আর্থিক সংগতি তাদের নেই। কুমুদিনী ট্রাস্টের অনেক ভূসম্পত্তি রয়েছে। সেই জায়গার কোথাও এই শ্রমিকদের পুনর্বাসন করা হোক।’

এ বিষয়ে কথা বলতে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পরিচালক মহাবীর পতির মুঠোফোনের নম্বরে কল করে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে শ্রমিকরা জানান, কারখানার কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হলে তাদের স্থানীয় কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ কাউন্সিলর খোরশেদের মাধ্যমে প্রতি শ্রমিক পরিবারকে ১০ হাজার করে টাকা প্রদান করবে। তবে এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বলেন, ‘কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বাসস্থান পরিবর্তন সাপেক্ষে মালামাল পরিবহনের জন্য ৩ হাজার টাকা প্রস্তাব করেছিল। শ্রমিকদের দাবি ছিল ১৫ হাজার টাকা। আমি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে উভয়পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করে দিয়েছি। যারা স্থান ছেড়ে যাবেন তাদের মালামাল পরিবহনের জন্য ১০ হাজার টাকা প্রদান করবে কারখানা কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকরাও এতে রাজি হয়েছে।’

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়