২৮ মার্চ ২০২৪

প্রকাশিত: ১৯:৫৬, ৩ এপ্রিল ২০২২

আপডেট: ১৯:৫৭, ৩ এপ্রিল ২০২২

বন্দর গণহত্যা দিবস

বন্দর গণহত্যা দিবস

রফিউর রাব্বি: শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিমে নারায়ণগঞ্জ শহর, পূর্ব পাড়ে বন্দর। একসময় বন্দর পাটের কল, জাহাজ নির্মাণের ডকইয়ার্ড ও খাদ্য গুদামের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। বৃটিশ শাসনামলে এ অঞ্চলে ইংরেজ ও আর্মেনিয়দের প্রায়ই দেখা গেলেও অবাঙালি বিহারিদের পদচারণা কখনোই ছিল না। কিন্তু সাতচল্লিশে দেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর রেডক্রসের উদ্যোগে বন্দরের বিভিন্ন স্থানে অবাঙালি বিহারিদের রিফিউজি ক্যাম্প স্থাপিত হয়। পরে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে এমন দাঁড়ায় যে কিছু কিছু পাড়া-মহল্লা ও এলাকা তারা দখলে নিয়ে নেয়।

একাত্তরের ২৫ মার্চ ঢাকায় পাক-হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। আর এর দুইদিন পর ২৭ মার্চ হানাদার বাহিনী পথের ব্যারিকেড তুলে তুলে নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রবেশ করতে চাইলে শহরে প্রবেশের মুখে মাসদাইর কবরস্থানের কাছে তারা প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। সেখানে একজন পাক সেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলে, তারা তাদের অস্ত্রসস্ত্র বৃদ্ধি করে পুনরায় হামলা চালায়। হানাদার বাহিনী সে এলাকার বিভিন্ন বাড়ি-ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়, মসজিদের ভিতরে আশ্রয় নেয়া নিরীহ সাধারণ মানুষকে মসজিদ থেকে ধরে এনে ও বিভিন্ন বাড়িতে হামলা চালিয়ে প্রায় ৪০ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। রাতে মাসদাইরস্থ নারায়ণগঞ্জ রসকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে অবস্থান করে। পরদিন সকালে তারা ভারি অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। আর এ সময়ের মধ্যে শহরের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ^রী নদী পার হয়ে বন্দর, নবীগঞ্জ, কলাগাছিয়া, আলীরটেক, বক্তাবলী, ডিগ্রিরচর, মুন্সিগঞ্জ, বিক্রমপুর ও বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য শহর ছেড়ে চলে যায়।

৪ এপ্রিল পাক-হানাদার বাহিনী শীতলক্ষ্যা নদী পাড় হয়ে বন্দর প্রবেশ করে। তারা ভোররাতে বিহারিদের সহায়তায় নবীগঞ্জঘাট ও কেরাসিনঘাট- এই দুই দিক দিয়ে একসঙ্গে বন্দরে প্রবেশ করে। নবীগঞ্জঘাট দিয়ে পাড় হওয়া গ্রুপটি প্রথমে ইস্পাহানী এলাকা ও জেলেপাড়ার বহু বাড়ি-ঘর গানপাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং এ এলাকা থেকে বহু লোককে ধরে বন্দর সিরাজদ্দৌলা ক্লাব মাঠে এনে হাজির করে। ক্লাব মাঠে আসতে আসতে রাস্তর পাশের অসংখ্য বাড়ি-ঘরে তারা গানপাউডার দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কেরাসিনঘাট দিয়ে পাড় হওয়া গ্রুপটি ডকইয়ার্ড দিয়ে উঠে সামনে অগ্রসর হয়ে হিন্দুঅধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকার বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। তারা লালজির আখড়া ও বৃন্দাবন আখড়া নামে হিন্দুদের দ’টি উপাসনালয় গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। সে এলাকা থেকে বহু লোককে ধরে সিরাজদ্দৌলা ক্লাব মাঠে এনে হাজির করে। উভয় গ্রুপই সকাল ন’টার মধ্যে ক্লাব মাঠে এসে পৌঁছায়। হানাদার বাহিনী সে সময় মাঠের ক্লাব ঘরে আশ্রয় নেয়া সাধারণ মানুষ ও ধরে আনা বন্দিদের মোট ৫৮ জনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। পরে আশপাশের বাড়িঘর থেকে মূলিবাঁশের বেড়া ও কাপড়-চোপড় এনে লাশের উপরে ফেলে গানপাউডার দিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিকেলে হানাদার বাহিনী শীতলক্ষ্যা নদী পাড় হয়ে শহরে চলে আসে। বন্দর বিরাণভূমিতে পরিণত হয়। বাড়ি-ঘর ফেলে অধিকাংশ মানুষ দিগি¦দিক পালাতে থাকে। অগ্নিদগ্ধ লাশের স্তূপ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসেন বেঁচে যাওয়া মুজিবুর রহমান কচি। পোড়া বাড়ি-ঘর ও মৃত মানুষের গন্ধে বন্দরের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। রাতে ক্লাব মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এলাকাবাসী ৫৪ জন হিন্দু-মুসলমান শহিদদের একসাথে গণ-কবর দেয়।

১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি আইয়ূব খানের পতন হলে সে বছর একুশে ফেব্রুয়ারির সিরাজদ্দৌলা ক্লাবের সদস্যরা বন্দরে বিভিন্ন বাড়ি-ঘর ও দোকান-পাটে কালো পতাকা উড়িয়ে দেয়। বন্দরে বসবাসরত বিহারিদের নেতা আইয়ূব মাষ্টারের আইয়ূব রেস্টুরেন্টেও ক্লাব সদস্যরা কালো পতাকা উত্তোলন করে। কিছুক্ষণ পর আইয়ূব মাষ্টার কালো পতাকা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলে ক্লাবের সদস্যদের নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ জনতা আইয়ূব রেস্টুরেন্ট ও সে সময়ের কনভেনশন মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সচিব মোহাম্মদ আলীর বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। পরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আইয়ূব মাষ্টার ও মোহাম্মদ আলীর বাড়ি দু’টি বন্দরে হানাদারদের নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নারায়ণগঞ্জে হানাদার বাহিনী প্রায় দুই শতাধিক গণহত্যা সংঘটিত করেছে। নারায়ণগঞ্জে রয়েছে একাত্তরের স্মারক হিসেবে অসংখ্য গণকবর, বদ্ধভূমি আর নির্যাতন কেন্দ্র। ৪ এপ্রিল সিরাজউদ্দৌলা ক্লাব মাঠের বদ্ধভূমিতেই পরবর্তীতে গড়ে উঠেছে শহিদস্তম্ভ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বেদনার ও গৌরবের স্মারক।

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়