২৫ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২২:৪০, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আপডেট: ২০:২৬, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাবা নেই বিশ্বাস করতে পারছি না, খুব অসহায় লাগছে

বাবা নেই বিশ্বাস করতে পারছি না, খুব অসহায় লাগছে

সৌরভ হোসেন সিয়াম (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): রোজরাতে বাবা বাসায় ফিরলে তাকে জড়িয়ে ধরতেন নুসরাত জাহান শ্রাবণ। রাত জেগে গল্প করতেন। মায়ের চেয়েও বাবার সাথে বেশি খাতির ছিল তার। সেই বাবা আর নেই তা কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না ১৮ বছর বয়সী এই তরুণীর। অশ্রুজলে ভেজা চিবুক মুছতে মুছতে শ্রাবণ বলেন, ‘বাবাকে ছাড়া কাউকে কখনও জড়িয়ে ধরিনি। রোজরাতে বাড়িতে ফিরলে তাকে জড়িয়ে ধরতাম। বাবা নেই, এইটা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। নিজেকে খুবই অসহায় লাগছে।’

শ্রাবণের বাবা শফিউল আলম কাজল (৪৭) সোমবার রাত পৌনে এগারোটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর আগে রোববার রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় ‘সুলতান ভাই কাচ্চি’ নামে রেস্তোরাঁর সামনে সড়কের ফুটপাতের উপর গুলিবিদ্ধ হন তিনি। কাজল ছিলেন ওই রেস্তোরাঁর মহাব্যবস্থাপক (জেনারেল ম্যানেজার)।

প্রত্যক্ষদর্শী রেস্তোঁরার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, পানি ও বিদ্যুতের বিল নিয়ে রেস্তোরাঁর মালিক ও যে ভবনে রেস্তোরাঁটি অবস্থিত ওই ভবনের মালিকের সাথে দ্বন্দ্ব চলছিল। এ নিয়ে তর্কের এক পর্যায়ে ভবনের মালিক আজহার তালুকদার তার হাতে থাকা পিস্তলের গুলি ছোড়েন। এই সময় গুলিবিদ্ধ হন কাজল। প্রথমে তাকে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এই ঘটনায় সোমবার সকালে রেস্তোরাঁ মালিক শুক্কুর আলী বাদী হয়ে তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার আজহার তালুকদার ও তার ছেলে আরিফ তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুইদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সোমবার তিনদিনের রিমান্ড আবেদন করে দুই আসামিকে আদালতে পাঠায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশ। মঙ্গলবার শুনানি শেষে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাওসার আলমের আদালত দুইদিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন।’

নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি আনিচুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও পানির বিল পরিশোধ নিয়ে দ্বন্দ্বে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। সোমবার রাতেই পুলিশ দুই অভিযুক্তকে আটক করে। তাদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মামলাটি হত্যার চেষ্টার অভিযোগে করা হলেও যেহেতু ভিক্টিম মারা গেছে, এটি এখন হত্যা মামলা হিসেবেই তদন্ত করা হবে।’

আসামি আজহার তালুকদারের নামে লাইসেন্স করা একটি পিস্তল ও একটি বন্দুক রয়েছে। অস্ত্র দু’টি পুলিশ জব্দ করেছে বলেও জানান ওসি।

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কুশিয়ারা গ্রামে নিহত শফিউল আলম কাজলের বাড়ি। পৈত্রিক ভিটার উপর একতলা ভবনের এক ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে থাকতেন তিনি। একসময় ব্যবসা করলেও গত ১২ বছর যাবৎ ‘সুলতান ভাই কাচ্চি’ নামে রেস্তোরাঁটিতে চাকরি করছেন বলে জানান তার পরিবারের লোকজন।

‘একটা মানুষ না পুরো পরিবারকে খুন করা হইছে’

মঙ্গলবার বিকেলে কাজলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় শোকের পরিবেশ। আত্মীয়-স্বজনরা ভিড় করেছেন তার বাড়িতে। মেঝেতে করা বিছানার উপর বসে কাঁদছেন স্ত্রী আসমা জামান। পাশে বসা মেয়ে নুসরাত জাহানও বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন পাশে। পঞ্চম শ্রেণি পড়–য়া শিশু কন্যা তাসনিয়া তারান্নুম ইকরা (১১) কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবার কথা তুলতেই চিবুক বেয়ে পানি পড়তে থাকে সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া তরুণী শ্রাবণের।

‘রোববার দুপুরে বাবা যখন বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন তখনই শেষ কথা হয়। তাকে বললাম, বাবা বুধবার আমার রেজাল্ট দিবে। তিনি আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, চিন্তা করো না, পরীক্ষা যেমন দিয়েছো রেজাল্ট তেমনই হবে। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠেই কথাগুলো বলছিলেন শ্রাবণ।

তিনি আরও বলেন, ‘রাতে ঠিকমতো কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমিয়েছি কিনা দেখতেন। না দিলে গায়ে জড়িয়ে দিতো। বাবা ছাড়া আর কাউকেই আমি কখনও জড়িয়ে ধরিনি। রাতে বাড়িতে ফিরলেই তাকে জড়িয়ে ধরতাম। সেই বাবা নেই আমি বিশ্বাস করতে পারতেছি না।’

একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অকূল-পাথারে পড়েছেন আসমা জামান। তিনি বলেন, ‘পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল আমার স্বামী। রেস্টুরেন্টে অনেকবছর যাবৎ কাজ করলেও বেতনটা মাত্র বেড়েছিল। সামনে সুখের দিন ছিল। কত স্বপ্ন ছিল, কত আশা ছিল। যা চিন্তা ছিল, স্বপ্ন ছিল সব শেষ। দুইটা মেয়েরে নিয়ে আমি কী করবো, কিছুই ভাবতে পারছি না।’

‘সাজানো গোছানো সংসার ছিল আমার। আমার স্বামী পরিবারভক্ত মানুষ ছিলেন। স্ত্রী-কন্যারা কী খাইবো, কী পরবো সেইটা নিয়াই সবসময় পইড়া থাকতো। মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারেও সবসময় খোঁজখবর রাখতো। মধ্যবিত্ত পরিবার হলেও কোনকিছুর কমতি রাখতো না। আমাদের জীবনটা যে কী হইয়া গেল!’

কাজল হত্যার বিচার দাবি করে তার স্ত্রী বলেন, ‘আমার স্বামীর সাথে কারও কোন দ্বন্দ্ব ছিল না। কোন অপরাধ ছিল না তার, অযথাই তারে গুলি কইরা মাইরা ফেললো। আমার একটাই অনুরোধ, যে লোক আমার স্বামীকে গুলি করে মারছে তার যেন ফাঁসি হয়। সে একটা মানুষ মারে নাই, পুরো পরিবারকে খুন করছে।’

ময়নাতদন্তের পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে মঙ্গলবার বিকেলে শফিউল ইসলাম কাজলের লাশ নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় ওই রেস্তোরাঁর সামনে আনা হয়। রেস্তোরাঁর সামনে নবাব সলিমউল্লাহ সড়কে লাশ নিয়ে বিক্ষোভ করেন নিহতের সহকর্মী ও স্বজনরা। তারা কাজলের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান। এই সময় বিপুল সংখ্যক পুলিশেল উপস্থিতিতিও দেখা যায়।

সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর চাষাঢ়ার বাগে জান্নাত জামে মসজিদে জানাজার নামাজ শেষে কাজলের লাশ নিজ গ্রামে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়