২৮ মার্চ ২০২৪

প্রকাশিত: ২১:২৪, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২

আপডেট: ২১:২৪, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২

বিপরীত স্রোতে ওয়াহিদ রেজা

বিপরীত স্রোতে ওয়াহিদ রেজা

রফিউর রাব্বি: সমাজের প্রচলিত প্রথা ও নিয়মের বাইরে নিজস্ব একটা নিয়ম তৈরী করতে চেয়েছিলেন ওয়াহিদ রেজা। তাঁর কবিতা ও গদ্যে সে ভাবেই নির্মাণ করতে চেয়েছেন নিজস্ব একটা ভাষা। নিজের মতো করে গড়তে চেয়েছেন নিজের ভুবন। ‘মানুষের লাশে গড়া এই সাঁকো পার হ’য়ে সকাল বিকেল সন্ধ্যে / সন্ধ্যে বিকেল সকাল করে / আমাকে পৌঁছুতেই হবে, পৌঁছুতেই হবে নীল নীল ফায়ারিংস্কয়াডের লাল রোদ্দুরে / ঈশ্বরের লোমহীন বুকে ক্রুশ বিদ্ধ করে চলে যাবো আমি।/ চলে যাবো প্রযত্ন গ্রাম থানা জিলা পকেটে পুরে-’ ঈশ্বরের সাথে এ ভাবেই বোঝাপড়া করতে চেয়েছিলেন তিনি ১৯৮০ সালে তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘দাঁড়াও কথা আছে’র মধ্যদিয়ে। প্রযত্ন গ্রাম থানা জিলা ছাড়িয়ে ষাট বছর বয়সে চিরতরে চলে যান ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি।

সত্তর দশকের কবি ওয়াহিদ রেজা কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও অনুবাদ সাহিত্যে একাধারে বিচরণ করেছেন। তিনি ভোলতেয়ারের ‘ক্যান্ডিড’ অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করেছেন মিলান কুন্দেরা ও আলবার্তো মোরাভিয়া। ভারতের যুক্তিবাদী লেখক প্রবীর ঘোষের সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ‘দুই বাংলার যুক্তিবাদীদের চোখে ধর্ম’। ওয়াহিদ রেজা যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতিগুলো উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। সমাজের প্রচলিত বাধা ও অচলায়তন ভাঙ্গার দৃঢ় প্রত্যয় ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কবিতা ও গদ্যে। ওয়াহিদ রেজা সব সময় সমাজের প্রচলিত নিয়ম ও গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে প্রেম ও দ্রোহের নতুন ভাষা নির্মাণে ব্রতী ছিলেন। তাঁর কবিতা ও গদ্য তাই যেমনি তীর্যক, তেমনি ধারালো। তাঁর একটি গ্রন্থ সম্পর্কে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেছেন, ‘ওয়াহিদ রেজা বিস্তর পড়াশোনা করে, বহু বইপত্র ঘেঁটে তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি বিভিন্ন পুরানের কাহিনীর কথা বলেন, যেমন প্রাচ্যের তেমনি প্রতীচ্যের। আমরা তাঁর গ্রন্থে ব্রহ্মা, ভৃগু, বিষ্ণু ও শিবের উপাখ্যান পাই। আমরা জিউস, জুনো, ভেনাস ও আইসিসের কথা শুনি আমরা ডায়োনিসাসের আরাধনার পাশাপাশি বৃক্ষ পূজার কথা শুনি। ওয়াহিদ রেজা একজন ব্যতিক্রমী মানুষও। আমাদের সাহিত্যের অন্যতম প্রথাবিরোধী বহুমাত্রিক লেখন তিনি। এবং প্রগতিশীল সংস্কৃতি কর্মী।’

১৯৫৬ সালের ২৫ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জে ওয়াহিদ রেজার জন্ম। প্রকৃত নাম আনিসুর রাব্বি। ওয়াহিদ রেজা তাঁর লেখক নাম। বাবা শাহাদাত হোসেন। ভাষাসংগ্রামী, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। পেশায় দন্ত চিকিৎসক। মা আনোয়ারা হোসেন। প্রগতিশীল রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আবহে কুসংস্কারমুক্ত এক পরিবারে ওয়াহিদ রেজা বেড়ে ওঠেন। তিনি ১৯৭২ সালে নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। তোলারাম কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে এইচএসসি ও ১৯৭৬ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলাদেশ ডেন্টাল এসোসিয়েশন থেকে ১৯৮০ সালে ডিএস ডিগ্রি গ্রহণ করে নারায়ণগঞ্জে তাঁর পিতার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান হোসেন দন্ত সদনে চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে ওয়াহিদ রেজার লেখালেখি শুরু। ১৯৭৬ সালে ‘শ্লোগান’ নামে প্রথম সাহিত্য সংকলন প্রকাশ করেন। ১৯৭৭ সালে ‘আমরা উহারা কিংবা তাহারাদের মতো নই আমরা আমরাই’র মতো দুর্বিনীত এক শ্লোগান নিয়ে সাহিত্য সংগঠন ‘ড্যাফোডিল’ যাত্রা শুরু করলে তিনি তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৭ সাল থেকে ‘ড্যাফোডিল’ তিনি একক সম্পাদনায় প্রকাশ করতে থাকেন। স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্য-গ্রন্থ ঘরে এখন পরপুরুষ। ১৯৭৮ সালে ‘শ্লোগান’ সম্পাদনার জন্য তিনি ‘মুক্তধারা জাতীয় পুরস্কার পান’। ১৯৭৭ সালে ‘তথ্য অধিদপ্তর পুরস্কার’ ও ১৯৮৭ সালে ‘গণশিল্পী সংস্থা পদক’ পান। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি জার্মান অবস্থান করেন। ১৯৮৮ সালে ওয়াহিদ রেজা মাহফুজা বেগমকে বিয়ে করেন এবং এর দশ বছর পর একটি সড়ক দূর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়।

ওয়াহিদ রেজার রচনার গভীরে অনুসন্ধিৎসু উপলব্ধি তাঁর ভাষার বিন্যাসে স্বতন্ত্র। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, সমালোচনা, উপন্যাস, পুরাতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণায় তাঁর বিচরণ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৩৫। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ দাঁড়াও কথা আছে, মহাকালের ইঙ্গিত, সুরঞ্জনার ফিরে আসা এবং তারপর, আব্রু, ঘরে এখন পরপুরুষ, লোকান্তরের যিশু, দীপালীর পরকীয়া বায়স্কোপ, তবু জীবন তবু তৃষ্ণা, নীল নায়ক, ইতিহাসের আলোকে ধর্ম পূজা যৌন পূজা , আসলে আমিই নায়ক, হে প্রেম হে সুন্দরা ইত্যাদি। তাঁর রচনা বিষয় নির্বাচনে ভিন্নতা, বক্তব্যের তীক্ষ্ণতা, আঙ্গিকের ভাঙচুর ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র ও আলাদা।

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়