১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২০:২৩, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

আপডেট: ১২:৫২, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

বীর প্রতীক গিয়াসউদ্দিনের বীরত্বের কাহিনী

বীর প্রতীক গিয়াসউদ্দিনের বীরত্বের কাহিনী

প্রেস নারায়ণগঞ্জ: গিয়াসউদ্দিন, বীর প্রতীক। বাবার নাম সামসুদ্দীন আহমেদ, মা আম্বিয়া খাতুন। মুক্তিযুদ্ধের দুঃসাহসী এক গেরিলা দলনেতা। বাড়ি নারায়ণগঞ্জের তল্লায়। নারায়ণগঞ্জের একমাত্র খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য গিয়াসউদ্দিনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩০৭। ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় মহাসচিব। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তরুণ গিয়াসউদ্দিন দেশমাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক সফল অভিযানের নায়ক গিয়াসউদ্দিন। ২৬ অক্টোবর ১৯৭১ ছিল এইরকমই এক সফল অভিযান। গিয়াসউদ্দিন খবর পান তাঁদের অবস্থানস্থলের দিকে নদীপথে এগিয়ে আসছে একটি পাকিস্তানি গানবোট। তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দলের দলনেতা। তাঁদের অবস্থান ছিল মেঘনা-শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনার কলাগাছিয়ায়।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গানবোট কখনো দিনে, কখনো রাতে ওই এলাকায় টহল দিত। গিয়াসউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে এর আগেও পাকিস্তানি গানবোটে আক্রমণ করার চেষ্টা করেন। কয়েকবার প্রস্তুতি নিয়ে নদীর তীরে অপেক্ষা করেছেন। ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যার পরও তিনি খাবার-দাবার সেরে সহযোদ্ধাদের নিয়ে সারা রাত নদীর তীরে অপেক্ষা করেন। কিন্তু গানবোট আসেনি।
ভোরে গিয়াসউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিজেদের গোপন শিবিরে ফিরে যান। বেলা ১১টার দিকে একজন স্থানীয় কৃষক দৌড়ে তাঁদের শিবিরে এসে তাঁকে পাকিস্তানি গানবোট আসার খবর দেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী ছিলেন। কৃষক তাঁকে জানান, তিনি নদীতে দূরে গানবোট দেখেছেন। সেটি কলাগাছিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে।
গিয়াসউদ্দিনসহ পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা তখন শিবিরে বিশ্রামরত। তাঁদের মধ্যে তিনিসহ ৩০ জন দ্রুত তৈরি হয়ে আরআর (রিকোয়েললেস রাইফেল) গানসহ পুনরায় অবস্থান নেন নদীর তীরের সুবিধাজনক স্থানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গানবোটটি তাঁদের অস্ত্রের আওতার মধ্যে চলে আসে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে তাঁদের আরআর গানসহ অন্যান্য সব অস্ত্র।
গিয়াসউদ্দিন তিনজন সহযোদ্ধার সহযোগিতায় নিখুঁত নিশানায় গানবোট লক্ষ্য করে তিনটি আরআর গোলা নিক্ষেপ করেন। তাতে গানবোটটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে একদিকে হেলে পড়ে। ডেকে থাকা পাকিস্তানি সেনারা ছোটাছুটি শুরু করে। এ সময় তাঁর দুঃসাহসী কয়েকজন সহযোদ্ধা এগিয়ে গিয়ে নিজ নিজ অস্ত্র দিয়ে গুলি করেন। তাঁদের গুলিতে নিহত হয় দুজন পাকিস্তানি সেনা।
এরপর গিয়াসউদ্দিন আরআর গানের আরও কয়েকটি গোলা ছুড়ে গানবোটটি পুরোপুরি ধ্বংসের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু তাঁর সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তুমুল গোলাগুলির শব্দ শুনে মুন্সিগঞ্জ টার্মিনাল থেকে সেখানে আরেকটি গানবোট দ্রুত চলে আসে। ওই গানবোট নদীতে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিয়ে তাঁদের ওপর বৃষ্টির মতো গোলাগুলি শুরু করে।
এরপর সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান করাটা ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। সে জন্য বাধ্য হয়ে গিয়াসউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এটি ছিল তাঁর দলের সফল এক অপারেশন। এ সংবাদ মানুষের মুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
গিয়াসউদ্দিন ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। উল্লেখযোগ্য সিদ্দিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন (১০ আগস্ট), লাঙ্গলবন্দের সেতু অপারেশন (আগস্টের মাঝামাঝি), ফতুল্লায় আক্রমণ।
নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার অন্তর্গত লাঙ্গলবন্দের সেতু। মুক্তিযুদ্ধকালে চারজন পাকিস্তানি ও দুইজন বাঙালি ইপিআর ওই সেতুতে পাহারা দিতেন। দুই ইপিআর তাঁদের সহযোগিতা করেন। গভীর রাতে গিয়াসউদ্দিন ২২ জন সহযোদ্ধা নিয়ে সেখানে আক্রমণ করেন। পাকিস্তানিরা পাল্টা প্রতিরোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। চারজনই নিহত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরক দিয়ে সেতু ধ্বংস করেন। 


গিয়াসউদ্দিন বীর প্রতীকের বীরত্ব নিয়ে নারায়ণগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা জি কে বাবুল তার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন, ‘ক্যাপ্টেন হায়দার ঢাকাকে অচল করে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে ঢাকায় আক্রমণ চালানোর জন্য গেরিলা যোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করেন ক্র্যাক প্লাটুন আর নারায়ণগঞ্জ মহকুমার জন্য গঠন করেন শহিদ কোম্পানি। এর দায়িত্ব দেন গিয়াস উদ্দিন বীরপ্রতীকের ওপর। এই দুই গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা চোরাগুপ্তা আক্রমণের মাধ্যমে ঢাকা নারায়ণগঞ্জের অফিস, আদালত, প্রশাসনিক কার্যক্রম ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত আঘাত হানেন। গেরিলা বাহিনী যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা অচল করার পাশাপাশি গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধেও অংশ নেয়।’

আড়াইহাজার উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. লাল মিয়া বলেন, জুনের শেষের দিকে গিয়াস উদ্দিনের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জের একদল মুক্তিযোদ্ধা আড়াইহাজার থানায় দুঃসাহসিক অপারেশন চালিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের সেই গ্রুপের সঙ্গে ঝাউগড়ার মুক্তিযোদ্ধা সিরাজও ছিল। এই অপারেশনের পর আড়াইহাজার থানা সদরে পাক মিলিটারি বাহিনী স্থায়ী ক্যাম্প করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করে দেয়ার জন্যই তাদের কার্যক্রম চলতে থাকে। কিন্তু আগস্টে ভারত থেকে ফিরে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়।

গিয়াসউদ্দিন ২০০৪ সালে মারা যান। সিটি করপোরেশন কিল্লারপুল থেকে তল্লা যাওয়ার সড়কটি তাঁর নামকরণ করা হয়। নতুন প্রজন্মের কাছে এই বীরদের বীরত্বগাঁথা দেশের জন্য তাঁদের ত্যাগ তুলে ধরতে হবে। বিজয়ের মাসে জানাচ্ছি এই বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়