২৮ মার্চ ২০২৪

প্রকাশিত: ২২:০২, ২২ আগস্ট ২০২২

আপডেট: ২২:০৪, ২২ আগস্ট ২০২২

মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও বামপন্থীদের হরতাল

মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও বামপন্থীদের হরতাল

বিমল কান্তি দাস: আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধিতে জাতীয় অর্থনীতি ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়তে শুরু করেছে। গত ৫ আগস্ট রাতে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। প্রতিকূল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলার অজুহাতে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ-এর কাছ থেকে যে ঋণ নিতে চলেছে তার গণবিরোধী পূর্বশর্তগুলো প্রতিপালনের লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

এই ঋণচুক্তির বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনার জন্য আইএমএফ-এর এক প্রতিনিধিদল জুন মাসে ঢাকা সফর করে। খুব শিগগিরই আরেকটি প্রতিনিধিদলও আসছে বলে জানা গেছে। অর্থ বিভাগের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনার সময় তারা ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জনের জন্য পাঁচটি পূর্বশর্ত দেয়। এর প্রথমটিই ছিল, `বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতসহ সার্বিক ভর্তুকি হ্রাস করে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা`। আর এই ভর্তুকি হ্রাসের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কয়েক দিন আগে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি করা হলো।

প্রসঙ্গত, আইএমএফ-এর সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক ঋণচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার আগেই সাহায্যপ্রার্থী সরকারকে তার সদিচ্ছার প্রমাণ হিসেবে আরোপিত শর্তসমূহ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধির ফলে অর্থনীতির বহু ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্যের মূল্যও বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।

তবে মুদ্রা তহবিল যে পাঁচটি পূর্বশর্ত দিয়েছে তাতে আরও বিপজ্জনক কিছু শর্ত আছে। তার একটি হচ্ছে, ‘বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে।’ বিশেষ করে ডলারের সীমা, দাম নির্ধারণ, ডলার ধরে রাখা ইত্যাদিতে কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণারোপ করা যাবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকারের হস্তক্ষেপ-নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। একে তারা বলে থাকে টাকার বিনিময় হারকে ভাসমান (ভষড়ধঃরহম) করা। এটা করা হলে টাকার দাম আরও কমে গিয়ে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি ঘটার সম্ভাবনা আছে। বিশেষত যখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নীতি হিসেবে সুদের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে তখন ডলারের দাম বাড়তেই থাকবে। এই পরিস্থিতিতে আগামী ২/৩ মাসের মধ্যেই ডলারের বিপরীতে টাকাকে ভাসমান করে দেওয়া হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অধিকর্তা জানিয়েছেন। আরেকটি শর্ত হচ্ছে, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো। এই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ফলে বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নিঃসন্দেহে।

আইএমএফ আসলে কোনো ব্যাংক নয়। এটা হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির স্বার্থ তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত এক বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা। যখন কোনো দরিদ্র দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষায় সমস্যার সম্মুখীন হয় তখন এই সংস্থাটি তাদের তথাকথিত বেইলআউট বা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসে। ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় সেই দেশটির অভ্যন্তরীণ নীতিমালা নির্ধারণের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব আইএমএফ-এর আমলাতন্ত্রের হাতেই ন্যস্ত থাকে। এবং এই সুযোগে সংস্থাটি বৈশ্বিক একচেটিয়া পুঁজির মুনাফার স্বার্থে দরিদ্র দেশগুলোর সর্বসাধারণকে প্রয়োজনে নিংড়ে নিয়ে হলেও স্বীয় দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে থাকে।

আমরা এখন আইএমএফ-এর সেই ঋণের ফাঁদেই পা দিতে চলেছি। এক্ষেত্রে গতানুগতিক বিরোধীতায় কোন লাভ নেই। প্রয়োজন আন্দোলনের মাধ্যমে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

জনজীবনের এই সংকটগুলো নিয়ে সর্বজনের মধ্যে আইএমএফ, সাম্রাজ্যবাদ ও তার সঙ্গে গাঁটছড়া বাধা স্বদেশীয় ধনিক শ্রেণির শোষণ-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তুলতে পারলে, দেশের জনগণকে মাঠে নামাতে পারলে এ সর্বনাশা পরিস্থিতি প্রতিরোধে সেই মহাজাগরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে।

মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য এখন প্রতিদিন কমছে, এখন ভর্তুকির প্রশ্ন কেন? আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের ব্যারেল প্রতি ১৪০ ডলার পর্যন্ত মূল্য উঠেছিল, এখন শুধুমাত্র ৯০ ডলার। এ ছাড়া গত ৭ বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কম থাকায় জ্বালানি তেলের আমদানি থেকে পিসিবি (সরকার) ৪৮ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। ৪৮ হাজার কোটি টাকা লাভ করার পর গত তিন মাসে মাত্র ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে; তার পরও ৪০ হাজার কোটি টাকা লাভ আছে। এতে তো ভর্তুকি দেয়ার প্রশ্ন আসে না।

জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়া রাষ্ট্রের জন্য কোন ক্ষতিকর কিছু নয়। পৃথিবীর সকল দেশে এটা করে থাকে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে সকল পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি হয়, অর্থনীতি ও বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়। এতে সাধারণ মানুষ বিপদের সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে আমাদের দেশের কৃষিতে ভর্তুকি না দিলে কোন ক্রমেই চলে না। এ ভর্তুকি দেয়া হয় জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। দেশ ও জনগণের স্বার্থে এ ধরনের ভর্তুকি দেয়া হয়ে থাকে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশ ও জনগণের যে অপূরণীয় ক্ষতি হবে তার চেয়ে ভর্তুকি দেয়া অনেক ভালো ছিল।

আমাদের দেশে যে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে তাকে আসলে ভর্তুকি বলা যায় না। একে অর্থনৈতিক লুটপাট বলতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও গত ১১ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৯০ হাজার কোটি টাকা বসিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে। এর মধ্যে শুধুমাত্র ১২টি কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা।

পিডিবি-র তথ্য অনুযায়ী এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে সামিট গ্রুপ পেয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা, যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল পেয়েছে ৭৩০০ কোটি টাকা, মালয়েশিয়া ভিত্তিক এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস ৭ হাজার কোটি টাকা, ইউনাইটেড গ্রুপ ৭৩০০ কোটি টাকা, বাংলাক্যাট ৪৫০০ কোটি টাকা, ওরিয়ন গ্রুপ ৪৩০০ কোটি টাকা, হোসাফ ও মোহাম্মদী গ্রুপ প্রতিটি ২ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা, ম্যাকস, সিকদার ও কনফিডেন্স গ্রুপ প্রতিটি ১ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা, ভারত থেকে আমদানির জন্য (সমকাল, ২৫ জুলাই ২০২২) ৫৮০০ কোটি টাকা।

এছাড়া সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় জানায় ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে প্রথম ৯ মাসে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য গেছে ১২ হাজার কোটি টাকা। এর আগে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে গেছে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা (প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০২২), ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ১৮ হাজার ১২৩ কোটি টাকা।

চুক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার তালিকায় এখন যোগ করা হচ্ছে এলএনজি ভিত্তিক ৩ টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এগুলো হচ্ছে সামিট, ইউনিক ও ভারতের রিলায়েন্স (বণিক বার্তা)।

জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা না দিয়ে বিনা উৎপাদনে বসিয়ে বসিয়ে দেশি বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানিগুলোকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে তার দায় কে নেবে? অপরিকল্পিত এই সব দেশবিরোধী ক্ষতিকর চুক্তি করা হয়েছে কমিশন খেয়ে, এসব লোকসানের দায় সেই সকল সরকারি কর্মকর্তাদের নিতে হবে, জনগণ কেন এর দায় নেবে? এখন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে, জনগণের পকেট কেটে, দেশের সর্বনাশ করে ভর্তুকি কমানোর উপায় বের করা হচ্ছে। এটাই পুঁজিবাদী অর্থনীতির লুটপাট। যেসকল কোম্পানিগুলোকে বিনা উৎপাদনে (বিদ্যুৎ) টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে আসলে তাদের সাথে পিডিবি’র সরকারি কর্মকর্তারা যুক্ত। তদন্ত করলে দেখা যাবে এসকল মেগা প্রজেক্টগুলোর দুর্নীতির সাথে সরকারের মন্ত্রী, এমপিরাও অনেকে জড়িত। লোক চক্ষুর আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে।
এ সকল ঘুষ-দুর্নীতির তদন্ত হওয়া উচিৎ। তা না করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মধ্যদিয়ে দেশের জনগণ ও জাতীয় অর্থনীতিকে বিপদগ্রস্ত করা হচ্ছে। সর্বনাশ করা হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষদের। এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে ইতিমধ্যেই দেশের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেছে। সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সকল প্রকার যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। যানবাহন মালিক ও মাফিয়া সিন্ডিকেটের বেপরোয়া লুটপাটের সুযোগ বেড়েছে। সার ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় গ্রামের কৃষক কৃষি কাজে বাধাগ্রস্ত হবে। বিদ্যুতের দাম আবারও বাড়বে। দেশে একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। এবারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে আরও কয়েক কোটি মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে নেমে যাবে। অন্যদিকে দেশে নতুন করে আরও কয়েক হাজার কোটিপতির জন্ম হবে। দেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। করোনা মহামারির পর থেকে দেশে একটা নিরব দুর্ভিক্ষ চলে আসছিল এখন সে দুর্ভিক্ষ প্রকাশ্য রূপ নেবে। দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য আরও বাড়বে।

এবার সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে গভীর রাতে; কোন আইনের তোয়াক্কা না করে অগণতান্ত্রিক পথে এটা করা হয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গণশুনানি করতে হয়, জনগণের মতামত নিতে হয়। এ একতরফা সিদ্ধান্ত একেবারে অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী কাজ হয়েছে। যদিও সরকার ‘জ্বালানি খাতে কোন মামলা করা যাবেনা’ মর্মে কালো আইন করে রেখেছে তবুও এক দিন না একদিন এসকল দুর্নীতির দায়ে দুর্নীতিবাজদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

সরকার কেন আইএমএফ এর ফাঁদে পা দিয়েছে? পদ্মা সেতু প্রকল্পের ক্ষেত্রে সরকার বিশ্বব্যাংকের বিরোধীতা করে ঋণ না নিয়ে নিজেদের টাকায় তৈরি করার বক্তব্য দিয়েছিল। সরকারের সে বক্তব্য জনগণ সমর্থনও করেছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই সেই আইএমএফ এর ফাঁদে পা দেওয়ার অর্থ কি? আসলে সরকার দেশে মেগা প্রজেক্ট হাতে নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কারণ মেগা প্রজেক্টগুলোর মধ্যে মোটা অংকের দুর্নীতির সুযোগ থাকে, ফ্লাইওভার নির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে। এবার আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছে মোটা অংকের ঋণের জন্য। ইতিমধ্যে দেশের মানুষকে বন্ধক রেখে দেশকে ঋণগ্রস্ত করে ফেলা হয়েছে; এ ঋণ কোনদিন শোধ হয়তো হবেও না। তারপর আবারো মোটা অংকের ঋণের দরকার হয়ে পড়েছে। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে দুর্নীতি আর লুটপাট। দুর্নীতির মধ্যদিয়ে একটা লুটেরা পুঁজিপতি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। একটা মাফিয়াতন্ত্র গড়ে উঠেছে। এ কারণে গণতন্ত্র নির্বাসিত হচ্ছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতাও নির্বাসিত হচ্ছে। একটা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চেপে বসেছে।

উন্নয়নের গালগল্প ফলাও করে প্রচার করার মধ্য দিয়ে জনগণকে ভুল বুঝানো হচ্ছে। জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে। যেমন প্রচার করা হতো, বিদ্যুৎ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে; হটাৎ শুরু হয়ে গেল চরম লোডশেডিং। প্রচার করা হোল দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে; দেখলাম হু হু করে চালের দাম বাড়ছে। দেশে উন্নয়ন যা হচ্ছে তা অল্পকিছু ধনীদের হচ্ছে; শ্রমজীবী মানুষ খুব কষ্টে আছে। বারে বারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে শ্রমিক কর্মচারীদের প্রকৃত মজুরি অনেক কমেছে। বিভিন্ন কারণে শ্রমজীবী মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছে। এমতাবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি মেহনতি মানুষদের মহাবিপদে ফেলেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন বর্তমানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কোন প্রয়োজন ছিল না। গত ৭ বছরে ৪৮ হাজার কোটি টাকা সরকার জ্বালানি তেল বিক্রি করে দেশের জনগণের কাছ থেকে যে লাভ করেছে সেখান থেকে সরকার সমন্বয় করে নিতে পারতো। পিসিবি ও কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে জ্বালানি থেকে লাভ করা বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংকে মজুদ আছে, সেখান থেকে সমন্বয় করে নিতে পারতো। সর্বশেষ, জ্বালানি তেল আমদানি থেকে সরকার বিভিন্ন ভাগে (প্রায়) যে ৩৬ শতাংশ শুল্ক নিয়ে থাকে তা থেকে কিছু ছাড় দিলেও সমন্বয় করে নেওয়া যেত। পাশের দেশ ভারতে রাষ্ট্রীয় শুল্ক কমিয়ে দিয়ে বহুবার জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করেছে; বাংলাদেশেও তা করা সম্ভব ছিল।

সরকার জ্বালানি তেলে যে ভর্তুকি দেবার কথা বলছে, তা সত্য নয়। গত ৭ বছরে তেল বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ টাকা লাভ করেছে। গত ৩ মাসে লোকসানের কথা বলা হলেও জ্বালানি তেলের ওপর ৩৪ থেকে ৩৬ শতাংশ শুল্ক নিয়ে সরকার যে লাভ (শুল্ক) করে তা তো বলছে না। প্রকৃতপক্ষে সরকার জ্বালানি তেলে কোন লোকসান বা ভর্তুকি দেয়নি।

এ ছাড়া বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমে আসছে, এমন সময় সরকারের মূল্য বৃদ্ধির কোন কারণ ছিল না। আসলে আইএমএফ এর ঋণের জন্য, তাদের (আইএমএফ) জাতীয় স্বার্থবিরোধী ক্ষতিকর শর্ত মেনে নিতেই সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ২৫ আগস্ট হরতাল ডেকেছে। মানুষের মনে এ নিয়ে নানান প্রশ্ন। এ হরতাল কি যুক্তিসংগত? বামপন্থীদের হরতাল কি সফল হবে?

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আগে দিতে চাই। হরতাল সফল করার মত সাংগঠনিক শক্তি বামপন্থী দলগুলোর নেই বলেই মানুষের ধারণা। মানুষের মধ্যে এ ধারণা তৈরি হয়েছে বামপন্থী দলগুলোর বিভক্তির কারণে। ঐক্যবদ্ধ থাকলে বামপন্থীরা বাংলাদেশে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে থাকত। দেশের মানুষ বামপন্থীদের নীতিগতভাবে বিকল্প ধারার রাজনৈতিক পক্ষ মনে করে। আসলেও তাই, বামপন্থীরাই রাজনৈতিক দিক থেকে প্রকৃতপক্ষে জনগণের বিকল্প শক্তি। অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার কারণে বামপন্থীরা জনগণের চোখে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে না। এর আগেও বাম গণতান্ত্রিক জোট হরতাল ডেকেছে। হরতাল ততটা সফল না হলেও দাবিগুলো জনগণ সমর্থন করেছে। এবার বামপন্থীদের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিকে মানুষ ব্যাপকভাবে সমর্থন করছে। এমনকি সরকারি দলের নিচ তলায় কর্মী ও সমর্থকরাও পর্যন্ত এ দাবি সমর্থন করছে। মানুষ যদি একবার জেগে ওঠে তবে হরতাল সফলও হতে পারে। এ দাবির (ইস্যু) প্রতি জনগণের বিপুল অংশের সমর্থনকে হরতালের অর্ধেক সফলতা ধরে নেওয়া যেতে পারে। বামপন্থীদের এ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদকে জনগণের পক্ষ থেকে অনেক বেশি মাত্রায় সমর্থন করতে দেখা গেছে। বামপন্থীরা হরতালে কোন গাড়ি ভাঙচুর করে না। গাড়ির মালিক ও চালকরা এ কারণে বামপন্থীদের ডাকা হরতালে সহজেই রাস্তায় গাড়ি বের করে থাকে। বামপন্থী দলগুলো তাদের হরতাল পালনের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখে পিকেটিং করে থাকে। সরকারি দল কিংবা পুলিশের পক্ষ থেকে কোন উস্কানিমূলক পরিস্থিতি তৈরি না করলে বামপন্থীদের সকল কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়। জনগণ উৎসাহিত হলে, রাস্তায় নামলে আগামী ২৫ আগষ্টের হরতাল সফল হতেও পারে, আমরা তাই আশা করি।

এ হরতাল কি যুক্তিসংগত? এ প্রশ্নের উত্তরে বলব শতভাগ যুক্তিসংগত। বামপন্থীরা ২৫ আগস্ট হরতাল ডাকার কারণে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সরকারি ভুল সিদ্ধান্তের সকল তথ্য-উপাত্ত জনগণের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করা সহজ হচ্ছে না। জনগণের পক্ষ থেকে কোথাও কোথাও প্রতিবাদও করছে। এ ইস্যুতে বাম ও প্রগতিশীলদের ব্যপক ঐক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষকদের পক্ষ থেকেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ করা হচ্ছে।

বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এ হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা দেয়ার মধ্য দিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি-জামাত ঘরানার সাথে বামপন্থীদের মৌলিক রাজনৈতিক পার্থক্য কিছুটা পরিস্কার হয়েছে। বিএনপি জোটগতভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে রাস্তায় নামেনি, কারণ তারা আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোন অবস্থান নেবে না। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সাথে তাদের কোন পার্থক্য নেই, পার্থক্য শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রশ্নে। কিন্তু বামপন্থীরা দেশ ও জনগণের স্বার্থে রাজনীতি করে তাই কম শক্তি সামর্থ্য নিয়েও গণবিরোধী সরকারি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে হরতাল আহ্বান করেছে। সরকারের এমন একটা গণবিরোধী সিদ্ধান্ত রুখে দিতে, জনগণের পক্ষে একটা হরতাল কর্মসূচি প্রয়োজন ছিল; আশাকরি জনগণ বাকিটা বিবেচনা করবে।

লেখক: বিমল কান্তি দাস, শ্রমিক নেতা

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়