২৮ মার্চ ২০২৪

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ১৯ এপ্রিল ২০২১

আপডেট: ১৫:৫৪, ২০ এপ্রিল ২০২১

শাকিলদের দিন আর ফেরে না

শাকিলদের দিন আর ফেরে না

সৌরভ হোসেন সিয়াম (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): সকাল সাতটায় রিকশা নিয়ে বের হন শাকিল। দুপুর একটায় পকেট হাতিয়ে দেখেন মাত্র ১৬০ টাকা। এদিকে গ্যারেজ মালিককেই জমা দিতে হবে ১০০ টাকা। নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় খালি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখেমুখে ক্লান্তির পাশাপাশি বিরক্তিরও ছাপ। জানালেন, কালিরবাজার থেকে একজন যাত্রী নিয়ে চাষাঢ়ায় এসেছেন প্রায় দেড় ঘন্টা হতে চললো। এর মধ্যে দ্বিতীয় কোনো যাত্রী পাননি।

কেবল শাকিল নন একই অবস্থা শহরের অন্যান্য রিকশাচালকদেরও। কাঙ্খিত যাত্রী পাচ্ছেন না তারা। সোমবার (১৯ এপ্রিল) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়েকজন রিকশাচালকের সাথে কথা বলে জানা যায়, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় সারাদেশে সর্বাত্মক লকডাউন চলছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বন্ধ শহরের মার্কেট, বিপণীবিতানসহ অন্যান্য দোকানপাট। ফলে লোকজনের আনাগোনাও কম। যারাই আবার শহরে আসছেন তাদের অধিকাংশই পায়ে হেঁটে চলাচল করছেন। কেউবা খরচ কমাতে ব্যবহার করছেন ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। এতে মুশকিলে পড়েছেন রিকশাচালকরা।

শাকিলের বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া গ্রামে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার দেওভোগ মাদরাসা এলাকায় একটি কক্ষে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাড়া থাকেন। স্বাভাবিক দিনগুলোতে একবেলা রিকশা চালালে ৫০০ টাকা উপার্জন হয়। গ্যারেজ মালিককে জমা দেওয়ার পর বাকি টাকা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে তার। সঞ্চয় বলতে কিছু নেই। এখন লকডাউনে শহরে মানুষের আনাগোনা কম হওয়াতে যাত্রীও কম। সাড়ে ছয় ঘন্টায় পেয়েছেন মাত্র ১৬০ টাকা। শাকিল বলেন, ‘এই টাকা থেইকা জমা দিমু কী আর নিজেরাই বা খামু কী! দুই কেজি চাইলের দাম ১১০ টাকা। এক পোয়া তেলের দাম ৩৫ টাকা।’

গ্রীষ্মের তপ্ত গরমে দরদর করে ঘামছিলেন শাকিল। শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলেন কিছুটা। অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া চোখ দু’টি ছলছল করছিল। ভাঙা কন্ঠে বলেন, ‘গতবারের লকডাউনেও কষ্ট করছি। এইবারও তাই। সবতের দিন ফেরে, আমাগো জীবন ফেরে না।’ এর মধ্যেই ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য তাড়া দেন তাকে। এখানে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। অবস্থা বেগতিক বুঝে রিকশায় উঠে প্যাডেল মারেন। রিকশার চাকা ঘুরতে থাকে জীবনের চাকা ঘোরানোর ক্ষীন আশা নিয়ে।

স্ত্রী ও চার শিশু কন্যাকে নিয়ে সাইফুলের পরিবার। স্ত্রী দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ হয়ে শয্যায়। একমাত্র উপার্জনকারী সাইফুল। দুর্মূল্যের এই বাজারে একবেলা প্যাডেলের রিকশা চালিয়ে যা উপার্জন তাতে দিব্যি চলে যেত তাদের। এখন আর চলে না। সাইফুল বলেন, ‘সকাল দশটায় বাইর হইয়া এখন পর্যন্ত ৮০ টাকা মারছি। এইতা থেইকা জমা দিমু কী আর আমরা খামু কী? করোনা মহামারীতে লকডাউন, ঘরতে লোকজন বাইর হয় না। আমরাও যাত্রী পাই না। কোনোমতে ২৫০ হইলে যামু গা। তাও হয় কিনা সন্দেহ।’ গ্রীষ্মের এই দাবদাহে এত কায়িক পরিশ্রমের মধ্যেও রোজা রেখেছেন বলে জানালেন সাইফুল। বলেন, ‘রোজা রাখলে একবেলা খাওন কম লাগে।’

লকডাউন চলাকালীন সড়কের কোথাও যাত্রীর আশায় দাঁড়াতে পারেন রিকশাচালকরা। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে রিকশা আটকে দেয় পুলিশ। লকডাউন অমান্য করে সড়কে বের হওয়াতে রিকশা উল্টে সড়কের উপর ফেলে রাখা হয়। আগের দিন সাইফুলের রিকশা উল্টে রাখতে গেলে রিকশার ডানা (পেছনের একটি অংশ) ভেঙে যায়। নিজ খরচে তা মেরামত করে আবারও বেরিয়েছেন রাস্তায়। বলেন, ‘ঘরে থাকলে তো আর কেউ খাওন দিয়াও জিগায় না।’

পুলিশ রিকশা আটক করতে পারে এমন ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও চাষাঢ়া পুলিশ বক্সের সামনে খালি রিকশা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় শাকিল ও সাইফুলের মতো আরও কয়েকজন রিকশাচালক। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া পথচারীর কাছে জানতে চান রিকশা লাগবে কিনা। পথচারীদের ‘না’ শুনে এক চালক যেন নিজ মনেই বলে ওঠেন, ‘সবতে হাঁইটা গেলে আমরা খামু কী?’

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়