১৮ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২১:০৯, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯

আপডেট: ২১:৪১, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি আসিফকে

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি আসিফকে

আফসানা আক্তার (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি তাকে। মেধা, অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সকল বাধা পেরিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

উত্তর চাষাঢ়ার কেএম আসিফ রহমতউল্লাহ্ জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী। হাতের আঙ্গুলগুলো বাকা, কথা বলতে সমস্যা এবং চোখ দুটিও অস্বাভাবিক (ট্যারা)। ছোটবেলা থেকেই কোনো সহযোগিতা ছাড়া চলাচল করতে পারে না সে। এমন অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও হাল ছাড়েনি আসিফ। নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগে চান্স পেয়েছে সে।

মাধ্যমিক থেকেই বিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়া করে এসেছে আসিফ। তবে কখনো কোনো টিউশনের প্রয়োজন হয়নি তার। যতটা শিখেছে তা তার স্কুল, কলেজের শিক্ষক, পরিবারের সাহায্যে ও নিজের মেধা দিয়েই শিখতে হয়েছে তাকে। আসিফ জানায়, ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি তার আকর্ষণ ছিল প্রচুর। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস ও ইতিহাসভিত্তিক বই পড়তে পছন্দ করে সে। এই আকর্ষণ থেকেই অর্জন করেছে সুধীজন পাঠাগার শ্রেষ্ঠ পাঠক পুরষ্কার। এছাড়াও অর্জন করেছে ভোকাভোলারি, সাধারণ জ্ঞান, চিত্রঙ্কন বিভাগে পুরষ্কার। এর পাশাপাশি স্কুল কলেজের বিতর্ক ক্লাবসহ বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যও ছিল সে।

সাফল্যের সবটাই তার বাবা মো. আলাউদ্দিন খন্দকারের কারণে। এমনটাই বললেন আসিফ। পড়াশোনাসহ সকল বিষয়েই তাকে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন বাবা। আসিফের মতে, তার প্রিয় বন্ধু তার বাবা না থাকলে হয়তো তার পড়াশোনাটাই হতো না।

প্রথম থেকেই ছেলের সব প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জানতেন ও বুঝতেন আলাউদ্দিন খন্দকার। আসিফের পড়াশোনার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল তার বাঁকা আঙ্গুল। হাতের আঙ্গুলগুলো বাঁকা হওয়ার কারণে আসিফের হাত স্থির ছিল না। ফলে সে লিখতে পারতো না। অন্যদিকে আসিফের কথা বলাতেও ছিল সমস্যা। ছেলের প্রতিবন্ধকতাগুলো প্রতিনিয়ত ভাবাতো তাকে। একদিন তিনি উপলব্ধি করেন আসিফকে যদি ছবি আঁকা ও গান শেখানো যায় তাহলে সারেগামা’র অনুশীলন তার কথা বলার সমস্যাটা দূর করতে পারে এবং ছবি আঁকা শিখতে শিখতে তার নড়বড়ে হাত স্থির করে তুলবে। যা তার লেখার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। যে ভাবনা, সেই কাজ। পাঁচ বছর বয়সী আসিফকে নারায়ণগঞ্জ শিশু একাডেমীর তিন বছর মেয়াদী একটি কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেন। প্রতিদিনই আসিফ সেখানে একটু একটু করে শিখতে থাকে। তিন বছর পর কোর্স শেষে দেখা যায়, আসিফের কথা বলা এবং হাতের লেখাতে পরিবর্তন এসেছে। এরপর থেকে আসিফকে আর কোনো বিষয়ে আটকে থাকতে হয়নি। মেধা ও কঠোর পরিশ্রম সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে তাকে।

আসিফের বাবা বলেন, ‘আমার মাথায় সারাক্ষণ ছেলের চিন্তা থাকতো। ওর বিষয়ে কখনো কাউকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। তাই অবসর পাবার পর অন্য কোনো চাকরিতে যাইনি। বিভিন্ন কারণে আসিফের স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। স্কুলগুলো বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে ছিল। বাড়ির সামনের রাস্তা ভালো না হওয়াতে রিকশা পাওয়া যেতো না। হুইলচেয়ারে করে প্রতিদিন আমাকেই ওকে স্কুলে নিয়ে যেতে হতো। যখন সড়কে পানি উঠে যেতো তখন আসিফকে কোলে করে হুইলচেয়ারসহ উচিয়ে নিয়ে যেত হত স্কুলে। ক্লাস চলাকালীন সময় আমি স্কুলেই বসে থাকতাম। আমার দুশ্চিন্তা হত, যদি ক্লাস চলাকালীন সময় ওর কোনো সমস্যা হয় তাহলে ওকে কে দেখবে। আশেপাশের অনেকেই অনেক কথা বলেছে কিন্তু আমি কখনো কানে দেয়নি। আমি জানতাম আসিফ কী, তারা তো জানতো না। আর যারা ওর সম্পর্কে জানাতো না তাদের কথা শোনার কোনো মানেও হয় না। তবে আমার ব্যর্থতা এই যে, আমি ওকে পড়াশোনার ভালো পরিবেশ দিতে পারিনি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে আসিফের কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে আসিফ বলেন, ‘প্রথম থেকে আমি কখনও কোচিং করিনি। একইভাবে ভর্তি পরীক্ষার জন্যও করিনি। তবে আমার বন্ধুরা যারা কোচিং করেছে তারা আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে। পাশাপাশি আমার ফুপাতো ভাই হাসিবুল হাসান আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। তবে পরীক্ষার ক্ষেত্রে আমি কিছু কৌশল অবলম্বন করেছিলাম।’

আসিফ তার প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জানত। সে জানত তার হাতের লেখা তেমন ভালো না আর লেখার ক্ষেত্রে অন্যান্যদের তুলনায় সময় ব্যয় হয় বেশি। তাই সে বহুনির্বাচনী পরীক্ষা প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়। আসিফ বলেন, ‘আমার প্রিপারেশন বহুনির্বাচনী পরীক্ষার জন্যই ছিল। আমি চেয়েছিলাম এর মধ্য দিয়েই ভালো মার্ক করার এবং বাকিটা লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে কভার করার। আমি যেমনটা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে ভালো ফলাফল করতে পেরেছি। এর জন্য আমি এবং আমার পরিবার অনেক খুশি।’

আসিফের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তার বাবা বলেন, ‘আসিফ এখন বড় হয়েছে। সে যা হতে চাইবে সেটাই হবে। এটা তার জীবন এবং সে যেভাবে চাইবে তাই হবে।’ এ বিষয়ে আসিফ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার জন্য নতুন একটি জগৎ। আমি আমার নতুন জগৎ উপভোগ করতে চাই। উপভোগের মধ্য দিয়ে যে উপলব্ধি তার মধ্য দিয়েই আগামীতে এগোতে চাই।’

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়