১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ২২ মে ২০২১

আপডেট: ১১:৩৬, ২৩ মে ২০২১

সরকারি সহায়তা চেয়ে উল্টো জরিমানা গুনলেন বৃদ্ধ ফরিদ (ভিডিওসহ)

সরকারি সহায়তা চেয়ে উল্টো জরিমানা গুনলেন বৃদ্ধ ফরিদ (ভিডিওসহ)

সৌরভ হোসেন সিয়াম (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ। ঘরে তার ১৬ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ছেলে, স্নাতক পড়ুয়া মেয়ে ও স্ত্রী রয়েছেন। এক সময়ে স্থানীয় এক হোসিয়ারি কারখানায় কাটিং মাস্টার হিসেবে কাজ করতেন। তিনবার ব্রেন স্ট্রোক করার পর ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ফরিদ এখন কাজ করতে পারেন না। ওই কারখানাতেই শ্রমিকদের উপর নজরদারি রাখা বাবদ মাসে ৮ হাজার টাকা পান তিনি। তাতে কষ্টেসৃষ্টে চলছিল তার সংসার। তবে করোনাকালীন সময়ে পড়েছেন মহাসংকটে। একরকম নিরুপায় হয়েই জাতীয় কলসেন্টারের ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা চান ফরিদ। এই একটি কলই কাল হলো তার।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নাগবাড়ি শেষ মাথা এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রেস নারায়ণগঞ্জকে বলেন, নিয়মিত এফএম রেডিও শোনেন তিনি। রেডিওতে সংবাদে তিনি জেনেছেন ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা পাওয়া যায়। সরকারি সহায়তা পেতে তিনি কল করেছিলেন ওই নম্বরে। কিন্তু সহায়তা তো পাননি, উল্টো তিনি চারতলা ভবনের মালিক এমন তথ্যের কারণে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছে তাকে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরার নির্দেশে তাকে ১০০ জনের মাঝে চাল, আলু, ডাল, লবন ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করতে হয়েছে।

ফরিদ উদ্দিন বলেন, তার আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ। কাজ করতে পারেন না। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। অন্য মেয়ে টিউশনি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জোগান। প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য নিয়মিত ওষুধ লাগে। তার নিজেরও দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। দুই চোখেই অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তিনবার স্ট্রোক করেছেন। কোনো রকমের সঞ্চয় নেই তার। নিজের ওষুধ কেনারও পয়সা নেই। ছয় ভাই ও এক বোন মিলে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিতে চারতলা ভবন করেছেন। চারতলায় উপড়ে টিন শেড দেওয়া দু’টি ঘরে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন ফরিদ। নিজে অসহায় অবস্থায় পড়েছেন বলেই সরকারি সহায়তার জন্য ওই নম্বরে কল করেছিলেন বলে জানান এই বৃদ্ধ। সহায়তা চেয়ে আরও বিপদে পড়েছেন তিনি। ১০০ জনকে খাদ্য সামগ্রী দেওয়ার মতো সামর্থ্য তার নেই। নিজের স্ত্রী ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর গয়না বিক্রি ও ধার-দেনা করে বিতরণের জন্য এসব খাদ্যসামগ্রী কিনেছেন বলেও জানান। এমনকি স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর থেকেও ধার নিয়েছেন ১০ হাজার টাকা।

ফরিদ উদ্দিনের ছোট ভাই শাহীন ও আরেক ভাইয়ের স্ত্রী বিলকিস বেগমও সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ফরিদ উদ্দিনের আর্থিক অবস্থা ভালো না। চারতলায় টিনশেডের দু’টো ঘরই তার সম্বল। অথচ তাকে চারতলা বাড়ির মালিক বলে জরিমানা করেছেন ইউএনও। বিলকিস বলেন, ‘১০০ জনের খাবার কেনার টাকা কই পাবেন আর না দিতে পারলে জেল হবে, এই লজ্জায় শুক্রবার রাতে দুইবার আত্মহত্যা করতেও চেয়েছিলেন আমার ভাসুর। মেয়েটা অবিবাহিত তাই লোকলজ্জার ভয়ে গয়না বিক্রি, ধানদেনা করে ৭০ হাজার টাকার খাদ্যসামগ্রী কিনেছেন।’

তবে সদর ইউএনও আরিফা জহুরা বলেন, সরকার ৩৩৩ কলসেন্টারের মাধ্যমে অসহায় ও দুঃস্থ মানুষদের খাদ্য সহায়তা প্রদান করছে। কেউ ওই নম্বরে কল করে তাদের সংকটের কথা জানালে উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও অফিসে জানানো হয়। পরে তা যাচাই করে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়। ফরিদ উদ্দিন নামে ওই ব্যক্তিও খাদ্য সহায়তা চেয়ে ওই নম্বরে কল করেন। পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই ব্যক্তি চারতলা ভবনের মালিক এবং যথেষ্ট স্বচ্ছল। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে ফরিদ উদ্দিনকে ১০০ গরীব মানুষকে সরকারি খাদ্য সহায়তার অনুরূপ প্যাকেট বিতরণ করার নির্দেশ দেন ইউএনও আরিফু জহুরা।

গতকাল শনিবার খাদ্যসামগ্রী বিতরণের সময় উপস্থিত ছিলেন ইউএনও আরিফা জহুরা, সদরের এসিল্যান্ড হাসান বিন আলী, কাশীপুর ইউপি’র ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আইয়ুব আলীসহ স্থানীয় এলাকাবাসী। এ সময় বিতরণ করা প্রতি প্যাকেটে সরকারি সহায়তার মতো ৫ কেজি চাল, ১ কেজি করে আলু, ডাল, সয়াবিন তেল, লবন ও পেয়াজ ছিল। এসব খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করার সময় ইউএনও’র সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফরিদ উদ্দিন ও তার পরিবারের লোকজন। তারা জানান, ধার-দেনা করে তারা এই খাদ্যসামগ্রী কিনেছেন। তাদের পারিবারিক অবস্থা অস্বচ্ছল ছিল বলেই ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা চেয়েছিলেন। তারা চারতলা ভবনের মালিক না।

ফরিদ উদ্দিনের বাড়ির পাশেই স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর বাড়ি। তিনি ফরিদ উদ্দিনের আর্থিক অবস্থার কথা জানতেন। যেদিন ইউএনও তাকে ১০০ প্যাকেট খাদ্য সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন সেদিনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন আইয়ুব আলী। তিনি কেন ইউএনও’কে সঠিক তথ্য জানালেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই ইউপি সদস্য দাবি করেন, তিনি ইউএনও’কে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। অল্প জরিমানা করারও অনুরোধ তিনি করেছিলেন। তবে ইউএনও তার কথায় পাত্তা দেননি বলে দাবি আইয়ুব আলী।

খাদ্য সহায়তা চাওয়া ফরিদ উদ্দিন সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল ছিল কিনা এবং লঘু পাপে তিনি গুরুদন্ড পেলেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও আরিফা জহুরা বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে এসব খোঁজখবর নেওয়া হয়। ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী তাকে ফরিদ উদ্দিনের আর্থিক স্বচ্ছলতার তথ্যই দিয়েছিলেন। এমনকি সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়েও তিনি একই তথ্য পেয়েছেন বলেই ওই নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে যেহেতু তার আর্থিক অস্বচ্ছলতার বিষয়টি সামনে এসেছে সে বিষয়ে যাচাই-বাছাই করবেন বলেও জানান আরিফা জহুরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাইন বিল্লাহ প্রেস নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ‘ওই ব্যক্তি তার স্বচ্ছলতার কথাই নাকি ইউএনওকে জানিয়েছিলেন। এখন যেহেতু নিজের অসহায়তার বিষয়টি সামনে এনেছেন সে অনুযায়ী তিনি আবেদন করলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে যে ধরনের সহযোগিতা করা যায় তা করা হবে।’

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়