২৯ মার্চ ২০২৪

প্রকাশিত: ০০:২৭, ২৭ নভেম্বর ২০২২

আপডেট: ০০:৩৮, ২৭ নভেম্বর ২০২২

হাজারো ছবি তুলে বুড়ো হয়েছি, আরও তুলতে চাই

হাজারো ছবি তুলে বুড়ো হয়েছি, আরও তুলতে চাই

সৌরভ হোসেন সিয়াম (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): বাবার ছবি তোলার শখ ছিল। শিশু বয়সে তাই সুযোগ হয়েছিল বিদেশী নামী ব্র্যান্ডের ক্যামেরায় ছবি তোলার। জাপান থেকে আনা বাবার ‘মামিয়া সিক্স’ এ হাতেখড়ি। ষাটের দশকে কিশোর বয়সে অসংখ্য ছবি তুলেছেন ‘লাইকা’ ক্যামেরায়। এই ক্যামেরাটি তার বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এক মার্কিন সৈনিকের কাছ থেকে ৪০ টাকায় কিনেছিলেন। তারপর কয়েক দশক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরেছেন, তুলেছেন অসংখ্য ছবি। পেয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিও।

বলছিলাম কোলকাতার আলোকচিত্রী মালা মুখার্জির কথা। শনিবার (২৬ নভেম্বর) সকালে নারায়ণগঞ্জ শহরের আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনে এক আড্ডায় ৭৬ বছর বয়সী এই আলোকচিত্রী তার অভিজ্ঞতার ঝাপি খুলে বসেন। নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক ক্লাব (এনপিসি) এই আয়োজন করে। এতে এনপিসি’র সদস্যরা অংশ নেন।

আয়োজক সংগঠনের সভাপতি জয় কে রায় চৌধুরী বলেন, নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফি ক্লাব প্রায়ই আমন্ত্রণ জানায় দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান আলোকচিত্রীদের। খ্যাতিমান এইসব আলোকচিত্রীর গল্প শুনতে আড্ডার আয়োজন করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এবার এনপিসি’র আয়োজনে কোলকাতার বিখ্যাত আলোকচিত্রী মালা মুখার্জিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

আড্ডার শুরুতে এনপিসি’র যুগ্ম সম্পাদক মুনতাসির মঈন আলোকচিত্রী মালা মুখার্জি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। তিনি বলেন, ষাটের দশকের আনকোড়া আলোকচিত্রী থেকে পেশাদার হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছেন মালা মুখার্জি। ১৯৮৬ সালে সকলে তাকে পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে পাওয়া যায়। তখন থেকেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, জার্নাল, বুক কভারে তার ছবি প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৯৩ সালে লন্ডনের গিল্ড হল ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাপ্লায়েড অর্ট অ্যান্ড ডিজাইন স্টাডিজে গ্রাজুয়েশন করেন তিনি। আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত এই আলোকচিত্রী বিভিন্ন সময় দেশ-বিদেশে সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি এককভাবে ৪৫টি এবং দলীয়ভাবে ৬৫টি প্রদর্শনী করেছেন। ২০০২ সালে বিখ্যাত পাবলিকেশন ‘ফাইডন’ তাকে বিশ্বের ১০০ জন ‘কনটেম্পরারি ফটোগ্রাফার’র তালিকায় স্থান দেয়।

কথার শুরুতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোলকাতার এই আলোকচিত্রী জানালেন তার পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায়। তিনি বলেন, ‘আমার যখন দু’বছর বয়স তখন বাবা জাপান থেকে কয়েকটি মামিয়া সিক্স ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলেন। সেই ক্যামেরাতেই আমার হাতেখড়ি। ছোট বয়সেই লাইকা ক্যামেরায় ছবি তুলেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোলকাতা ছেড়ে যাওয়ার সময় আমেরিকান এক সোলজারের কাছ থেকে চল্লিশ টাকায় ক্যামেরাটি কিনেছিলেন বাবা। এই ক্যামেরা নিয়ে শিলং গিয়েছিলাম। ফিল্ম ভরে ছবিও তুললাম। ফিরে যখন ছবিগুলো বের করার সময় জানতে পারলাম, ফিল্মটাই ঠিকমতো লাগানো হয়নি।’

হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘ওইটা ছিল লাইকা ক্যামেরার প্রথম ব্যবহার। নিজে ভুল করার পর সবসময় অন্যদের বলেছি, ফিল্ম ঠিকমতো আছে কিনা সেটা দেখে নিও।’

দীর্ঘ সময়ে অনেক কাজ করলেও বিজ্ঞাপনে কাজ করেননি বলে জানান পেশাদার এই আলোকচিত্রী। নিজেকে ‘স্বাধীনচেতা’ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি খুবই সাধারণ লোক, সাধারণভাবেই ছবি তুলি। পুরোপুরি নিজের আনন্দে ছবি তুলি। আমি বিখ্যাত অনেকের অ্যাসাইনমেন্টও অনেক করেছি। কিন্তু যেখানে স্বাধীনতা পেয়েছি সেখানেই কাজ করেছি, মহানন্দে ছবি তুলেছি।’

‘তবে বিজ্ঞাপনের ছবি আমি কখনও তুলিনি। বিজ্ঞাপনের ছবিতে অনেক পরীক্ষা দিতে হয়। আমি অত পরীক্ষা দিতে পারি না। ছোটবেলা থেকেই পরীক্ষা দিতে আমি ভালোবাসি না।’ যোগ করেন তিনি।

প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা ছাড়াই দীর্ঘদিন ছবি তুলেছেন বলে জানান মালা মুখার্জি। ‘একটি ছাগলের উচু হয়ে পাতা খাওয়ার’ মুহুর্ত ধারণই ছিল তার প্রথম কাজ। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের লোকজনই গিনিপিগ হতো। তাদের দাড় করিয়ে দিয়ে ছবি তুলতাম। শিক্ষিত না হবার কারণে ছোটবেলা থেকেই একটা স্বাতন্ত্র্যতা ছিল। আজও যেখানে যা ভালো লাগে তাই দেখে মনের আনন্দে ছবি তুলি। মন খারাপের সময়ও ছবি তুলি।’

অনেক প্রাপ্তির মধ্যে হতাশার গল্পও শোনালেন তিনি। একাধিকবার না জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে ছবি ব্যবহার করার খবর পেয়ে হতাশ হয়েছেন। ‘কপিরাইট আইন’ নিয়ে আলোকচিত্রীদের সচেতন থাকার পরামর্শও দেন তিনি।

লন্ডনে থাকাকালীন অভিজ্ঞতার কথাও জানান মালা মুখার্জি। বাংলাদেশ ও কোলকাতার চেয়েও বড় ইলিশ সেখানে খেয়েছেন, বলেন তিনি।

পাঠাগারের পঞ্চম তলার ‘পরীক্ষণ হলে’ চলছিল এই আড্ডা। কথার ফাঁকে ফাঁকে মালা মুখার্জির তোলা কিছু আলোকচিত্রী প্রদর্শিত হচ্ছিল পেছনের পর্দায়। সেসব ছবির প্রেক্ষাপটও বর্ণনা করছিলেন তিনি। অধিকাংশ আলোকচিত্রই পুরোনো ভবন ও দেয়ালের। এই ‘সাবজেক্টের’ প্রতি অনুরাগের কথাও অকপটে স্বীকার করলেন তিনি। আড্ডায় আলোকচিত্র নিয়ে দু’একজনের প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছিলেন।

আড্ডার শেষদিকে তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার ছবি তুলেছি। এখন বুড়ো হয়ে গেছি তো। তারপরও ছবি তুলে যেতে চাই। যেখানে আগে ছবি তুলেছি, সেখানে আবারও যাই। আগের মতো পাই কিনা খুঁজি। কিন্তু কিছুই আর আগের মতো থাকে না। কেউই থাকে না।’

আয়োজনের দ্বিতীয় পর্বে আলোকচিত্রের উপর ‘ফটোগ্রাফিক বুক শো’ চলে। এতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আলোকচিত্রীর দুর্লভ সব বই প্রদর্শন করা হয়। এই ধরনের ‘বুক শো’ নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছে বলে দাবি জয় কে রায় চৌধুরীর।

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়