২০ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২২:০৬, ২ নভেম্বর ২০১৯

৩ নভেম্বর গার্মেণ্টস ট্র্যাজেডি, নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক অভ্যুত্থান

৩ নভেম্বর গার্মেণ্টস ট্র্যাজেডি, নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক অভ্যুত্থান

প্রেস নারায়ণগঞ্জ: ২রা নভেম্বর ২০০৩ মধ্য রাত, ফতুল্লা বিসিকে, প্যানটেক্স ড্রেস লিঃ গার্মেণ্টেসের গেইটে অবস্থান ধর্মঘটরত শ্রমিকদের সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হলো, হঠাৎ সেখানে ৩ জন ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত হয়ে মালিকের শিপ্মেণ্ট খালাস করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। এজন্য তারা আন্দোলনরত শ্রমিকদের সাথে নানা প্রকার আশ্বাস দিতে থাকে। অতীতে মালিকদের আশ্বাসের নামে ধোঁকাবাজির অভিজ্ঞতা এবং অবিশ্বাসের কারণে আন্দোলনকারী শ্রমিকরা আমার উপস্থিতি ছাড়া মালিক প্রশাসনের সাথে কোন বৈঠক করতে রাজি না হওয়াতে, রাত সোয়া ১১ টায় মোবাইলে ওসি ফতুল্লা আমাকে বলেন- আন্দোলরত শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান করার জন্য তারা আমাকে সহ বসতে চায়। ওসি ফতুল্লাকে বলি, আগের দিন বিকাল ৫টায় মালিক-শ্রমিক দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে শ্রমিকদের পক্ষে আমি ছিলাম। শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিটি মেনে না নেওয়ার কারণে সমস্যার সমাধান হয়নি। তখন ঐ পুলিশ অফিসার অধিক আগ্রহে আমাকে বলেন, আপনি যদি এখন আসেন, তবে পুনরায় আলোচনা করে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস-সহ ১৮ দফা দাবি নিশ্চিত সমাধান করা হবে। তার সামনে বসা তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট (এন.ডি.সি) সৈয়দ বেলাল হোসেন, মানজারুল মান্নান ও প্রকাশ কান্তি তাদের নাম পরিচয় দিয়ে, তারা আমার সাথে কথা বলেন। মালিক ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি এখন মেনে নিয়েছে। তখন তারা আর দেরি না করে আমাকে বিসিকে আসার জন্য অনুরোধ করলেন এবং আরো জানালেন ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস-সহ ১৮ দফার চুক্তিনামাটি কম্পিউটারে টাইপ করা হচ্ছে। তারা আমার জন্য গাড়ি পাঠাতে চাইলে আমি বলি দরকার নেই। সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিষয়টি অবহিত করে আমি রাত প্রায় সাড়ে ১২ টায় রিকশায় বিসিকে রওনা দেই। এমনিতেই ছিল শীতের কুয়াশা, আবার রমজান মাসের কারনে বিসিকের অধিকাংশ কারখানার বাতি নেভানো থাকায় চারদিক ছিল অন্ধকার। তখন প্যানটেক্স গার্মেণ্টস-এর গেটের সংগ্রামী শ্রমিক ভাই-বোনেরা ৩ দিন যাবৎ শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছে।

কথায়-কথায় শ্রমিক ছাটাই, ২/৪ মিনিট দেরী করে গেলে হাজিরা কেটে দেয়া, সাপ্তারিক ছুটি না দেয়া, একদিন ‘এব্সেণ্ট’ করলে ৩ দিনের হাজিরা কেটে দেয়া, অসুস্থ হলে ছুটি না দেয়া, কর্মদিবস ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১২/১৪ ঘণ্টা, নারী শ্রমিকদের রাত্রিকালীন কাজে বাধ্য করা, শিপ্মেণ্টের নামে একটানা ৩/৪ দিন ফ্যাক্টরিতে আটকে রাখা। সময় মতো বেতন না দিয়ে ঘুরানো, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা। এক কথায় দীর্ঘদিন যাবৎ গামেন্টস্ মালিকদের অমানবিক শোষণ-নির্যাতনের কারণে গার্মেণ্টস শ্রমিকদের মনে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ঘনিভূত হয়ে তখন চরম আকার ধারণ করেছিল। এছাড়াও ৫-৬ মাস যাবৎ ফতুল্লার পলমল গার্মেণ্টেস, বিসিকের ফকির এপ্যারেলস্, সমাস্ রেডিওয়্যার, এসি বাংলা, তামান্না গার্মেণ্টস্, জি,আর ফ্যাশনসহ বহু কারখানায় শ্রমিকেরা নিজেদের দাবিতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে আস্ছিল।

এদিকে ডিউটির ফাঁকে-ফাঁকে এবং সাপ্তাহিক ছুটি পেলে অথবা কাজ শেষে রাতে গার্মেণ্টস শ্রমিকেরা আমার সাথে তাদের সুবিধা-অসুধিার কথা সবসময় জানাতো। এমনিভাবে শ্রমিকেরা আমার সাথে সার্বক্ষণিক ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক যোগাযোগ রাখার মধ্য দিয়ে এবং বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে আন্দোলনরত এক কারখানার শ্রমিক অন্য কারখানার শ্রমিকদের সাথে পরিচয় গড় তোার সুযোগ পায়। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকায় আন্দোলনমুখী শ্রমিকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার এক প্রকারে কমরেড সুলভ বন্ধুত্বের স¤পর্ক গড়ে উঠে।

এদিকে বিসিকের চারদিকে আন্দোলনের উত্তাপ তখন ক্রমশঃ বেড়ে চল্ছিল। শ্রমিকদের আন্দোলনমুখী এই টগবগে অবস্থা প্যানটেক্স গার্মেণ্টস মালিক পক্ষ কখনোই কেয়ার করার প্রয়োজন মনে করেনি। উপরন্তু নিজেকে স¦রাষ্ট্র সচিবের আত্মীয় বলে মিথ্যা পরিচয় জারি করে, সরকারি দল ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে, উক্ত মালিক বেপরোয়া-মারমুখী হয়ে উঠেন। শ্রমিকদের উপরে দমন-পীড়ন খুবই বাড়িয়ে দেয়, এমনকি রমজান মাসে শ্রমিকদের নামাজের সময় অযুর পানির কল পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়, এতে শ্রমিকেরা আরো উত্তেজিত হয়ে উঠে।

এই ঘটনায় শ্রমিকেরা ফতুল্লা থানায় জি.ডি এণ্ট্রি করে এবং মালিক সংগঠন বিকেএমইএ ও জেলা প্রশাসককে স¥ারক লিপি দিয়েও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। প্যানটেক্স গার্মেণ্টস-এর শ্রমিকেরা এমনিতর অবস্থায় ১৮ দফা দাবি আদায়ের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠে। মালিক দাবী না মেনে তালবাহানা করার কারণে শ্রমিকেরা শিপ্মেণ্ট আটকে দিয়ে কারখানা ঘেরাও করে অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি গ্রহনণ করতে বাধ্য হয়। এটাই ছিল তখন তাদের একমাত্র পন্থা, যাতে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের ক্ষমতা ও উৎপাদনে শ্রমিকদের অবদানকে স্বীকার করতে পারে।

আমি সেখানে গিয়ে টেলিফোনে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যে কথা হয়েছে, তা কারখানার গেটের সামনে আন্দোলনরত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে সবকিছু অবহিত করি।

প্যানটেক্স গার্মেণ্টসে খবর নিয়ে জানতে পারি ভিতরে কেউ নেই, মালিক-পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটরা পার্শ্ববর্তী এমভি গার্মেণ্টসের ৭ তলায় বসে আছে। নেতা পর্যায়ের কয়েকজন গার্মেণ্টস শ্রমিককে সংগে নিয়ে আমি সেখানে যাই। মালিক কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের কর্তারা আমাকে বলে, দাবি-টাবি পরে দেখা যাবে, আজকে শ্রমিকদের আন্দোলন বাদ দিয়ে চলে যেতে বলেন। আমি তাদের বলি, এটা আমার দ্বারা বলা সম্ভব নয়। কারণ কথা অনুযায়ী কাজ না হলে, আমি শ্রমিকদের কিছু বলতে পারবো না। এ সময়ে ম্যাজিস্ট্রেট, মালিক ও তাদের কয়েকজন মাস্তান সবাই আমার সাথে চোখ রাঙ্গিয়ে উগ্র ভাষায় কথা-বার্তা বলতে থাকে, এক পর্যায়ে তারা মাতালের মতো বেপরোয়া আচরণ শুরু করে, আমাকে নরমে-গরমে হুমকি-গালি-গালাজ করতে থাকে। পিস্তল শো-করে এ সময়ে তারা আমাকে প্রানে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। রাত ২ টার দিকে ৭ তলা থেকে আমাকে-সহ সহ নিচে নামতে বাধ্য করে ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে মালিক ও পুলিশের কর্তারা শ্রমিকদের অবস্থান-ধর্মঘটের স্থানে যেয়ে, শ্রমিকদের আন্দোলন বাদ দিয়ে চলে যেতে বলে। শ্রমিকরা বলে, যে মালিক কিছুক্ষণ আগে এক কথা বলে ২ ঘণ্টার মধ্যে সে কথা পাল্টিয়ে ফেলে, তাকে বিশ্বাস করা যায় না। শ্রমিকেরা তাদের দাবির ব্যাপারে আরো অনড় হয়ে উঠে। এবার ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কর্তারা সরাসরি মালিকের পক্ষ নিয়ে শিপ্মেণ্ট খালাশ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ম্যাজিস্ট্রেট বেলাল হোসেন চোখ লাল করে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে সরাসরি হুমকি দিয়ে বলে, আন্দোলন বাদ না দিলে শ্রমিকদের লাশের উপর দিয়ে তারা শ্পিমেণ্ট করাবে। সুতরাং এটা পরিস্কার যে, শুরু থেকেই মালিক-প্রশাসন আলোচনা নয়, দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছিল। রাত ৩টার দিকে পুলিশ আমার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। কারণ জানতে চাইলে তারা আমার উপর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। এরপরে আমার বিরুদ্ধে কোন মামলা বা অভিযোগ না থাকার পরেও ভোর সোয়া ৫টার দিকে আমাকে গ্রেফতার করে একটি মাইক্রোবাসে করে ফতুল্লা থানায় নিয়ে যায়।

সকাল পৌনে ৬টায় বন্দি অবস্থায় থানার ওয়্যারলেস সেটে বিসিকে গুলির শব্দ শুনতে পাই। পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র আন্দোলনরত অসহায় শ্রকিদের উপর। মিনিটে-মিনিটে গুলির আওয়াজ শুধু বাড়তেই থাকে। এস.পি ওয়ারল্যাস সেটের মাধ্যমে একের পর এক হত্যাকান্ডের সবরকম সতর্কমূলক নির্দেশনা দিতে থাকে। এই সময়ে থানার ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমে ভেসে আসতে থাকে শ্রমিকদের আর্তচিৎকার। নারকীয় আক্রমণে তখনই গুলিতে নিহত হন প্যানটেক্স গার্মেণ্টসের শ্রমিক আমজাদ হোসেন কামাল। প্রায় ২ শত শ্রমিক গুলিবিদ্ধ এবং বহু শ্রমিক নিখোঁজ হয়ে যায়।

সকাল ৮ টার দিকে পার্শ্ববর্তী মুন্সীগঞ্জ এবং নরসিংদী জেলা থেকে ট্রাকে করে অসংখ্য দাঙ্গা পলিশ ও বিডিআর নারায়ণগঞ্জ-এসে অ্যাক্শনে নামে।

সকাল সাড়ে ৮ টায় এস.পি থানায় ওয়্যারলেস করে পুলিশ অফিসারের নিকট জানতে চায় আমাকে থানায় কোথায় রাখা হয়েছে। তখন পুলিশ অফিসার জানায়, আমাকে ডিউটি অফিসারের রুমে একটি চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এস.পি তখন থানায় ওয়্যারলেস সেটে নির্দেশ দিয়ে বলে, হাজার হাজার শ্রমিক তাকে মুক্ত করার জন্য থানার দিকে মিছিল করে আস্ছে। জলদি এড. ইসমাইলকে লক-আপে বন্দি করো। তখন আমাকে লক-আপের ভিতরে বন্দি করা হয়।

রমজান মাসের পরিবর্তিত ডিউটির সময়সূচির কারণে সকাল ৭ টার দিকে কারখানামুখী লাখো শ্রমিক রাস্তায় পুলিশের টিয়ার গ্যাস আর হাজার-হাজার রাউন্ড গুলির শব্দে আতংকগ্রস্থ হয়ে উঠে। শ্রমিকের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, শ্রমিক হত্যা এবং বিনা কারণে আমাকে থানায় আটক করার সংবাদ বিসিকসহ পাশ্ববর্তী সকল গার্মেণ্টস কারখানায় দাবানলের আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশি অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে গার্মেণ্টস শ্রমিক সহ বসতির আশে-পাশের বাসা-বাড়ী, বিক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী হঠাৎ নামা বন্যার মতো রাস্তায়-রাস্তায় ব্যাপক প্রতিরোধের ব্যারিকেড গড়ে তোলে।

মূহুর্তের মধ্যে প্রতিরোধের আগুন আগ্নেয়গিরির মতো তীব্র গতিতে পুরো শহর প্রকম্পিত করে তোলে। শহরের চতুর্দিকে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সমূদ্রের ঢেউয়ের মতো অনবরত মিছিলের পর মিছিল চলতেই থাকে। প্রতিরোধের মিছিল যেন শেষ হতে চায় না। একটানা চারদিন নারায়ণগঞ্জ প্রশাসনের অত্যাচারের খড়গ দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙ্গে পড়ে যায়, রাজপথ দখল করে নেয় বিপ্লবী গার্মেণ্টস শ্রমিকেরা।

সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পঞ্চবটি, শাসনগাঁও, কাশিপুর, জামতলা, ফতুল্লা, বিসিকের ৫০-৬০ হাজার বিক্ষুদ্ধ শ্রমিক সকল পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙ্গে বীরদর্পে থানা থকে আমাকে মুক্ত করার জন্য ফতুল্লা থানা ঘেরাও করে ফেলে। এ সংবাদ জানতে পেরে পাগলা, শ্যামপুর, কাঠেরপুল, পোষ্টঅফিসে এলাকা-সহ পার্শ্ববর্তী সকল কল-কারখানার শ্রমিকেরা কারখানা বন্ধ করে দিয়ে বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মতো শুধু ফতুল্লা থানার দিকে ছুটে আসতে থাকে।

সাংবাদিক শরিফউদ্দিন সবুজ, কামাল, ফটো সাংবাদিক প্রণব সাহা, পাপ্পূ ভট্টাচার্য, শ্যামল, শিপন, জিয়া, ফতুল্লা প্রেসক্লাবের সভাপতি-ওবায়দুল্লাহ তাৎক্ষণিকভাবে লক-আপে এসে থানার বাইরের পরিস্থিতি আমাকে অবগত করে। সাংবাদিকদের মাধ্যমে থানার বাহির থেকে ৪ জন গার্মেণ্টস শ্রমিক নেতাকে ডেকে এনে আমি তাদের সকলকে থানা থেকে কোর্টে চলে যেতে বলি।

মিনিটে-মিনিটে থানার চারদিকে শ্রমিক-জনতার চাপ ক্রমান্বয়ে ভয়াবহ আকারে শুধু বাড়তে থাকে। যে কোন সময় বিরাট রক্তারক্তি হয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে থানা থেকে সকল পুলিশ যে-যেভাবে পারে দ্রুত পালিয়ে যায়। একজন বৃদ্ধ সেণ্ট্রি ছাড়া থানা তখন পুলিশ শূন্য।

থানার চতুর্দিকে শ্রমিকদের শ্লোগারে গর্জন প্রকট আকার ধারন করছে, থানা কেঁপে উঠছে। এমনতর মুহুর্তে বাধ ভাঙ্গা প্লাবনের মতো গর্জন করে হাজার হাজার শ্রমিক থানার ভিতরে ঢুকে পড়ে। ২/১ সেকেন্ডের মধ্যে সেণ্ট্রির চিৎকার, ইসমাইল ভাই আমাকে বাঁচান, সেণ্ট্রি লক-আপের তালা খুলে দেয়, সে প্রাণ বাচানোর জন্য নিজেই লকেআপে ঢুকে পড়ে। লক-আপ থেকে বের হয়ে যে দৃশ্য দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমার মনে হয় ঐ মুহুর্তে হাজার হাজার শ্রমিক মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছিল।
থানা থেকে বের হয়ে মেইন রোডে এসে গণমিছিল শহরে যাওয়া শুরু করতেই, সামনের দিক থেকে মিছিলে পুলিশ বেপরোয়াভাবে শর্টগানের গুলি চালাতে শুরু কর। আমি তখন মিছিলের একেবারে সমানে। গুলিতে ৭০/৮০ জন শ্রমিক আমার সামনে ই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। গুলি আরও বাড়তে থাকলে হাজার হাজার শ্রমিক এদিক-ওদিক দৌড়াতে থাকে। পুলিশ এ সময়ে রাস্তায় শ্রমিকদের উপরে পাকবাহিনীর কায়দায় বর্বর অত্যাচার চালাতে থাকে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির আইনজীবীরা জানায় কোর্ট-কাচারি সব বন্ধ করে দিয়েছে, পরিস্থিতি খুবই খারাপ । পরে এ সময়ে ১১ দল নেতা এড. মণ্টু ঘোষ ও শফিউদ্দিন আহমেদ এর সাথে ফোনে কথা হলে সবাই আমাকে জজ কোর্টে চলে আসতে বলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ১১ দলের নেতৃত্বে হাজার হাজার শ্রমিকের একটি বিশাল মিছিল ডিসি কোর্টে ঢুকে ডিসি কোর্ট ঘেরাও করে ফেলে।

এদিকে শহর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিক্ষোভ মিছিল যেন শেষ হতে চায় না। প্রতিরোধের ঢেউ ঝড়ের বেগে বেড়েই চলেছে, আশে-পাশের এলাকায় অন্যান্য পেশার শ্রমিক ও মেনতি মানুষেরাও ঐক্যবদ্ধভাবে ঐ আন্দোলনে এগিয়ে আসতে থাকে। শহরে চলতে থাকে অঘোষতি হরতাল, কেন্দ্রীয় শ্রমিক নেতা সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রণ্টের সভাপতি কমরেড আবদুল্লাহ সরকারের সাথে স্থানীয় ১১ দল নেতাদের-তাৎক্ষণিক সভায় শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে ৫ নভেম্বর ২০০৩ নারায়ণগঞ্জে হরতাল।

রাতে বেসরকারি টিভি চ্যানেল এবং পরের দিন সংবাদপএে এখবর জানতে পেরে সারাদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। প্রগতিশীল বামপন্থি রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠন ঢাকায় বিক্ষোভে ফেটে পরে। ধিক্কার, নিন্দা জানানো হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। অবশেষে পরিস্থিতি বে-গতিক দেখে সরকার প্রশাসন তাদের অ্যাকশন থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ৫ নভেম্বর হরতাল চলাকালিন প্রখ্যাত আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামালা হোসেন এবং বাসদ আহবায়ক কমরেড খালেকুজ্জামান সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ছুটে আসেন ২নং রেল গেইট-এর রক্তে ভেজা বিশাল শ্রমিক সমাবেশে। সমাবেশে এক দাবি, শ্রমিক হত্যার বিচার চাই, করতে হবে।

অতঃপর ৬ ডিসেম্বর‘০৩ (প্রেসক্লাব ভবরে উপরে) মালিক সংগঠন বিকেএমইএ কার্যালয়ে সরকারের পক্ষে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, চেম্বার অব কমার্স, বিকেএমইএ এবং শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ত্রিপক্ষীয় একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

একদিকে চুক্তি আর অন্যদিকে মালিক পক্ষ চালিয়ে যায় সরকারি দলের ক্যাদারদের নিয়ে সশস্ত্র মহড়া। আন্দোলনে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করার জন্য রাতে ১১ দল নেতৃবৃন্দের বাড়ীতে, ১১ নভে¤¦র চাষাড়া শহীদ মিনারে শোক সভায় এবং প্রকশ্য দিবালোকে বিকেএমইএ কার্যালয়ে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের ডিআইজি এবং ডিসি, এসপি‘র উপস্থিতিতে ত্রি-পক্ষীয় মিটিং-এর মধ্যে বিএনপি‘র সরকার দলীয় সন্ত্রাসী ডেভিড বাহিনী (পরে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত) কয়েকবার আমার উপরে প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে সশ্রস্ত হামলা চালায়।

অবশেষে সরকারীভাবে গঠিত ১ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত না হওয়ায়, গত ২৭ মার্চ ২০০৪ইং নারায়ণগঞ্জের আলী আহম্মদ চুনকা পাঠাগার মিলনায়তনে প্রগতিশীল আইনজীবী ফোরামের উদ্যোগে এক নাগরিক সমাবেশে ড. কামাল হোসেন সাবেক বিচারপতি জনাব হাবিবুর রহমান খানকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট গণতদন্ত কমিশন ঘোষনা করেন।

ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দেয়া হয় নাঃ শ্রমিকেরা যেন তাদের দাবির কথা বলতে না পারে এবং মালিকদের জুলুম নিপীড়নের বিরুদ্ধে কেউ যেন প্রতিবাদ করতে না পারে, সেজন্য মালিকেরা নানা অজুহাত দেখিয়ে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠণ করতে দেয় না। মালিকদের অসহনীয় জুলুম-নির্যাতনে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ৩রা নভেম্বর একটি বিস্ফোরণ মাত্র।

বাস্তবে পুঁজিবাদী ঐ রাষ্ট্র ব্যবস্থা জনগণের সেবার নামে আজ তারা উৎপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ। সমাজে যত প্রকার জুলুম, অবিচার, ক্ষুধা-দারিদ্রতা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সৃষ্টি। পুঁজিবাদের নিজের সৃষ্টিকরা সংকট-সমাধানে আজ সে ব্যর্থ। দুনিয়ার সর্বহারার মহান নেতা কার্ল মার্কস বলেছিলেন, পুঁজিবাদ শ্রেণী মুনাফার জন্য যে শ্রমিক শ্রেণীকে সৃষ্টি করে চলেছে,সেই শোষিত শ্রমিক শ্রেণীই একদিন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কবর রচনা করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ করবে।

নারায়ণগঞ্জে ৩রা নভেম্বর শ্রমিক অভ্যুত্থান বিপ্লবী সংগ্রামের এক খন্ড ইতিহাস, দীর্ঘদিন মার খাওয়া শ্রমিকেরা আজ মাথা উঁঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছে। রাজপথে শ্লোগানের ধবনিতে প্রতিবাদের ভাষা নিজেদের অস্তিত্বের শক্তিকে অনুভব করতে শিখেছে। একবার মা ডাক শিখে যে শিশু, সে ডাক আর ভুলে না, তেমনি দুনিয়ার মজদুর এক হও শ্লোগান একবার যে শ্রমিক শিখেছে সে কখনো আর ভুলবে না। শহীদ আমজাদ হোসেন কামালের রক্ত বৃথা যেতে পারে না।

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়