১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২১:৩৭, ২ নভেম্বর ২০২০

৩ নভেম্বরের শ্রমিক অভ্যুত্থান

৩ নভেম্বরের শ্রমিক অভ্যুত্থান

বিমল কান্তি দাস: ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর আনুমানিক ভোর ৫টায় ফতুল্লার বিসিক শিল্প নগরী প্যানটেক্স ড্রেস লিঃ এর শ্রমিকদের অবস্থান ধর্মঘটের সমাবেশে পুুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হয় ঐ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক আমজাদ হোসেন কামাল এবং আহত হয় দুই শতাধিক শ্রমিক। আমি তখন ঐ প্রতিষ্ঠানের পাশে অন্য একটি কারখানায় রাতের শিফটে কর্মরত ছিলাম। গুলির শব্দ শুনে আমরা বিল্ডিং এর ছাদে গেলাম। তখনো আধো অন্ধকার। দেখলাম কয়েকটি গলিতে শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। এক পর্যায়ে বৃষ্টির মত গুলির শব্দে আতংকিত হলাম। সকালের শুরুতেই প্রথমে পাশের কারখানা এবং দুই এক ঘন্টার মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সকল শিল্প এলাকার শ্রমিক রাস্তায় নেমে মিছিল শুরু করল। কিছুক্ষন পরেই দেখলাম প্রতিটি এলাকায় শ্রমিকরা মিছিল করছে। তার মধ্যে আনুমানিক দুই লক্ষ শ্রমিক মিছিল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরে চলে এসেছে।

এই আন্দোলনের প্রধান নেতা এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইলকে ফতুল্লা থানায় আটক রাখার কারনে কয়েক হাজার শ্রমিক ফতুল্লা থানা ঘেরাও করেছে। সেখানে গুলি হচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করা যাচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে এক পর্যায়ে ফতুল্লা ও নারায়ণগঞ্জ সদর থানার পুলিশ নিজেরাই থানা ছেড়ে নিরাপদে সরে যেতে বাধ্য হয়। পুলিশ যখন এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইলকে ছাড়ে তার পূর্বেই নারায়ণগঞ্জের সকল যানবাহন, দোকান পাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারী অফিস আদালত শতভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। পুলিশ বিডিআর সহ সকল সরকারী বাহিনীকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুরু হল অঘোষিত হরতাল। এই হরতাল ছিল কয়েকদিন। জেলার সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান এক সপ্তাহ বন্ধ ছিল।

৩ নভেম্বর সকাল ১১টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নারায়ণগঞ্জের সকল শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দদের একটি মিটিং হয়েছিল। সেখানে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি দাবীনামা দেওয়া হল। শ্রমিকদের ঐ দাবীর সাথে শ্রমিক লীগ, শ্রমিক দল, জাতীয় শ্রমিক পার্টি ও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন একমত না হতে পারায় আমরা ১১ দলের (তৎকালীন) পক্ষ থেকে আন্দোলনে থাকলাম। ঐ সময়ে আমি ১১ দলের জেলা সমন্বয়ক থাকায় একেবারে ভিতর থেকে ঘটনাগুলো দেখার সুযোগ হয়েছে। পরবর্তিতে শ্রমিক লীগসহ ঐ ৪টি সংগঠন প্রশাসনের সাথে যুক্ত হয়ে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। ৪ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রিয় ঈদগা মাঠে আমজাদ হোসেন কামালের জানাজা হবার কথা ছিল কিন্তু পুলিশ লাশ দিল না। ৪ নভেম্বর বিকেলে ১১ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন এবং প্রশাসনের সাথে একটি বৈঠক হয়েছিল।

৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা ১১ দলের পক্ষ থেকে ২৪ ঘন্টা হরতাল ডাকা হয়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত মিছিল এসেছিল। হরতালের সমাবেশে প্রায় এক লক্ষ শ্রমিক জমায়েত হয়েছিল। ড. কামাল হোসেনসহ ১১ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সমাবেশে বক্তব্য রেখেছিলেন। ২০০৩ সালের ৪, ৫ ও ৬ নভেম্বর সকল টেলিভিশন ও জাতীয় পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম ছিল এই আন্দোলন। রাশেদ খান মেনন, মঞ্জুরুল আহসান খান, হায়দার আকবর খান রনো, বদরুদ্দিন ওমরসহ ২০জন জাতীয় নেতা পত্রিকায় এ প্রসঙ্গে উপ-সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। এ আন্দোলন প্রসঙ্গে দুইটি বই বেরিয়েছিল। আন্তর্জাতিক প্রধান প্রধান প্রচার মাধ্যমগুলো কয়েকদিন যাবৎ এই আন্দোলনের সংবাদ প্রচার করেছিল। ১১ দলের ব্যনারে এই আন্দোলনের শীর্ষবিন্দুতে ছিলেন এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইল। এছাড়াও নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন এড. মন্টু ঘোষ, শফিউদ্দিন আহমেদ, আবু নাঈম খান বিপ্লব, বিমল কান্তি দাস, আব্দুল হাই শরীফসহ বাসদ সিপিবি ও ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা নেতৃবৃন্দ। একটানা দেড় মাস আন্দোলনের মাথায় মালিক পক্ষের সাথে শ্রমিক পক্ষের একটি চুক্তি হয়। মালিক পক্ষ সে চুক্তি আজও বাস্তবায়ন করে নাই। কামাল হত্যার বিচার হবার কথা ছিল তাও হয় নাই।

২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জের এই শ্রমিক অভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রথম বিদ্রোহ। এর আগেও গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন হয়েছে। তবে এত বড় আকারে হয়নি। ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত যারা ঐ সময়ে নারায়ণগঞ্জে উপস্থিত ছিলেন তাদের নিশ্চয়ই সেই ঘটনাগুলো স্মরণে থাকবে। এ প্রসঙ্গে আমরা দুটি বই বের করেছিলাম। তাতে এই অভ্যুত্থানের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। পরবর্তী প্রজন্মের হয়তো তা কাজে লাগবে। কিন্তু সে আন্দোলনের বর্ননা দেওয়া এ লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়।

যে বাস্তব পরিস্থিতির কারনে ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের বিসিক শিল্প এলাকায় শ্রমিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তেমন একটি বাস্তবতা তৈরী হয়েছে। সরকারী কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুন করা হয়েছে। কিন্তু বেসরকারী শ্রমিকদের এক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হয়েছে। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কয়েকটি কালো আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে শ্রমিকরা বিক্ষুব্দ। কারখানায় কারখানায় মালিক পক্ষের অতিরিক্ত কাজের চাপ আর খারাপ আচরণ শ্রমিকদের মানসিক যন্ত্রনা বৃদ্ধি করছে। গুন্ডা, মাস্তান, ভয়ভীতি, হামলা, মামলা, ছাঁটাই নির্যাতন প্রতিমুহুর্তে শ্রমিকদের মানসিকভাবে বিক্ষুব্দ করে তুলছে। কথা বলার অধিকার, সংগঠন করার অধিকার, সভা সমাবেশের অধিকার একেবারে সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তি ও মেশিনারীজের কারনে ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে-শ্রমিকদের রুটি-রুজি, জীবন-জীবিকা এক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিপতিত হচ্ছে। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার কার্যত নেই, গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। তাদের মানসিক যন্ত্রনা ও ক্ষোভ দৃশ্যত চোখে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ক্রমাগত পুঞ্জিভূত হচ্ছে। যেহেতু শ্রমিকদের জন্য গণতন্ত্র নেই ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকান্ডের সুযোগ নেই তাই পুঞ্জিভূত এই ক্ষোভের অনিবার্য বিস্ফোরন ঘটবে। আবারও ফিরে আসবে ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর, হয়তো আরও একটু বড় আকারে।

লেখক: বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিমল কান্তি দাস

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়