২৬ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ১৯:০৯, ২৯ নভেম্বর ২০১৯

আপডেট: ২১:৩৩, ২৯ নভেম্বর ২০১৯

৪৮ বছরেও স্বীকৃতি পায়নি বক্তাবলীর ১৩৯ শহীদ

৪৮ বছরেও স্বীকৃতি পায়নি বক্তাবলীর ১৩৯ শহীদ

প্রেস নারায়ণগঞ্জ: ৪৮ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বক্তাবলী গণহত্যায় নিহত ১৩৯ শহীদের। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্যকোন সরকারই শহীদ পরিবারগুলোর খোঁজ নেয়নি। কেবল প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতিতেই বেঁচে আছে হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও বক্তাবলীবাসীর গৌরবের ইতিহাস। নিজের পূর্বসূরীদের ইতিহাস না জেনেই বড় হচ্ছে বক্তাবলীর নতুন প্রজন্ম। গত ৪৭ বছর যাবৎ ২৯ নভেম্বরের গণহত্যায় শহীদদের স্বীকৃতি, বক্তাবলীর ইতিহাস ও বধ্যভূমি রক্ষার দাবি জানিয়ে আসছে শহীদ পরিবারগুলো।

মুক্তিযুদ্ধ ও বক্তাবলী: মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা জুড়েই শত্রুমুক্ত ছিলো বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী ঘেরা দূর্গম বক্তাবলী পরগনা। যুদ্ধের শুরু থেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বক্তাবলীতে ভিড় করে নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ। বর্ষার শেষের দিকে মুক্তারকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কানাইনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ঘাটি গড়েন মুক্তিযোদ্ধারা। বক্তাবলী থেকেই নারায়ণগঞ্জ ও আশপাশের এলাকার অপারেশন সংগঠিত হতো জানিয়ে যুদ্ধকালীন কমান্ডার আমিনুর রহমান বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধের পুরোটাজুড়েই বক্তাবলীতে আশ্রয় নেয়া লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের আগলে রেখেছিলো বক্তাবলীর কৃষক পরিবারগুলো। তাদের আন্তরিকতার কারণে ছোটবড় প্রায় ১২টি মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠে বক্তাবলীতে। তাদের আশ্রয় ও খাবারের সংস্থান করেছে বক্তাবলী পরগণার ২২টি গ্রামের মানুষ। এখানেই স্থানীয়দের কেউ কেউ প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।’

২৯ নভেম্বর ১৯৭১: কুয়াশাচ্ছন্ন ছিলো ২৯ নভেম্বরের ভোর। নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় ২৮ নভেম্বর মধ্য রাতেই গানবোটসহ ধলেশ্বরীতে অবস্থান নেয় হানাদার বাহিনী। বক্তাবলীকে তিন থেকে থেকে ঘিরে ফেলে। কুয়াশাতেই বক্তাবলী চরে নামতে থাকে পাকিস্তানী সেনারা। হানাদারদের উপস্থিতি টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে প্রায় ২ ঘন্টা প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে। এই সময়ের মধ্যেই বক্তাবলীর ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ পাশের মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হয়। প্রতিরোধের মুখে প্রথম দফায় পিছু হটলেও ভারি অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ফের বক্তাবলীর গ্রামগুলোতে হামলা চালায় হানাদাররা। বিকেল পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ফিরে যায় তারা।

সেদিনের ঘটনা স্মরণ করতে পারেন মুক্তিযোদ্ধা তমিজউদ্দিন রিজভী। বলেন, ‘মাহফুজুর রহমানদের প্রতিরোধের সময়ই আমরা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিই। ওদের আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রের মুখে আমাদের লড়াই করা সম্ভব ছিলো না। সারাদিনই ওরা গ্রামগুলোতে তা-ব চালিয়েছে।’ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বৃদ্ধ সেকান্দার আলী জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে গান পাউডার দিয়ে বক্তাবলীর ২২টি গ্রাম পুড়িয়ে দেয় হানাদাররা। গ্রামের যুবকদের ধরে হত্যা করে। ডিক্রিচর ঘাটে একসঙ্গে হত্যা করা হয় ৪০ জনকে। পরবর্তীতে স্থানীয়রা হিসেব করে দেখেন, ২৯ নভেম্বরের বক্তাবলী গণহত্যায় ১৩৯ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হয়েছে।

হারিয়ে যাচ্ছে বক্তাবলীর ইতিহাস: ১৯৭১ সালের ছাই হয়ে যাওয়া ভিটাগুলোতে নতুন বসতি গড়েছেন শহীদ পরিবারের সন্তানরা। ছাই হয়ে যাওয়া পিতৃভূমি আবারো সাজিয়েছেন নতুন করে। তবে গত ৪৮ বছরেও ২৯ নভেম্বরের শহীদ ১৩৯ জনকে সরকারি স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। লিখা হয়নি গণহত্যার ইতিহাস। সম্প্রতি বক্তাবলী গণহত্যা নিয়ে কথা হয়েছে মুক্তারকান্দি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, মুক্তারকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কানাইনগর ছোবহানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্তত ২১ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় বক্তাবলীতে কী হয়েছিলো?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ বলেছেন ভাষা আন্দোলন হয়েছিলো। কেউ বলেছেন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা মারা গিয়েছিলো। তাদের কেউই মুক্তিযুদ্ধে বক্তাবলীর অবদান কিংবা ২৯ নভেম্বরের গণহত্যার ইতিহাস বলতে পারেনি।

কানাইনগরের মুক্তিযোদ্ধা গিয়াসউদ্দিন বলেন, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তাবলী গণহত্যায় শহীদ পরিবারদের প্রতি চিঠি লিখে সমবেদনা জানিয়েছিলেন। শহীদ পরিবার প্রতি ২ হাজার ও আহতদের ৫শ’ করে আর্থিক সহযোগিতাও করেছিলেন। তারপরের ৪৭ বছরে কোন সরকারই শহীদ পরিবারগুলোর কথা মনে রাখেনি।’ বক্তাবলী গণহত্যার ইতিহাস রক্ষায় ১৩৯ শহীদ ও লক্ষ্মীনগর বধ্যভূমিকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি প্রদান ও সরকারিভাবে বক্তাবলী দিবস উদযাপনের দাবি জানান ‘বক্তাবলী পরগনা মুক্তিযোদ্ধে শহীদ পরিবার সংঘ’র সভাপতি হারুন অর-রশীদ।

৪৮ বছরেও গণহত্যার স্বীকৃতি না পাওয়া দুঃখ জনক উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন বলেন, ২০০৪ সালে ২৯ নভেম্বরের শহীদদের স্মরণে সরকারি উদ্যোগে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে লক্ষ্মীনগর বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বক্তাবলী গণহত্যায় শহীদ ও লক্ষ্মীনগর বধ্যভূমির সরকারি স্বীকৃতি আদায়ে যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

লেখক: গোলাম রাব্বানি শিমুল

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়