২৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

আপডেট: ১৭:২৯, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০

আগেও শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের মামলা করেছিলেন তিনি

আগেও শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের মামলা করেছিলেন তিনি

সৌরভ হোসেন সিয়াম (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে স্বামীকে খুঁজতে এসে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ এক নারীর (২৩)। এই মামলার আসামি রমজান আলীকে (৩২) মঙ্গলবার (২৯ সেপ্টেম্বর) ভোরে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার রমজান আলী উল্লাপাড়া উপজেলার কেশবগঞ্জের বাসিন্দা। সে বাদীর স্বামী কারিমুল ইসলামের ভগ্নিপতি। রমজানের দাবি, তিনি কখনই নারায়ণগঞ্জে আসেননি। উল্লাপাড়ায় চা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি সারাদিন চা বিক্রি করি। রাতের বেলা বাইত্তে (বাড়িতে) থাকি। যেই রাইতের কথা কইতাছে, ওই রাইতে আমি বাইত্তে ছিলাম। এই মামলা পুরাটাই মিথ্যা। আমি জীবনেও নারায়ণগঞ্জে আসি নাই। আমারে বেডে (বিছানা) থেইকা পুলিশ ধইরা আনছে।’

এদিকে মামলায় বাদী উল্লেখ করেছেন, তার স্বামী গত এক মাস যাবত নিখোঁজ। তাকে খুঁজতে বের হয়ে গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাহেবপাড়া বাজার এলাকায় স্বামীর বন্ধু গাজীপুর সদরের বাউপাড়া গ্রামের সামছুল বিশ্বাসের ছেলে মো. মহসিনের (৩৫) সঙ্গে দেখা হয়। স্বামীর সন্ধান জানেন বলে ওই নারীকে সাহেবপাড়া এলাকার একটি চারতলা ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করেন মহসিন। এরপর একই কক্ষে গ্রেফতার রমজানও তাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের সময় ওই নারীর আড়াই বছরের শিশু পাশেই ছিল বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। ২৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, একই অভিযোগে মামলার বাদী ওই নারী গত বছরের ১৮ জুন ডিএমপির খিলগাঁও থানায় গণধর্ষণের একটি মামলা করেছিলেন (মামলা নং- ৪৪)। ওই মামলায় বাদী তার স্বামীর ছোট ভাই, ছোট বোনের স্বামীসহ ৬ জনকে আসামি করেন। এই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। প্রতিবেদনে পুলিশ উল্লেখ করেছে, বাদী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে ফাঁসানোর জন্য মিথ্যা মামলা দিয়েছে। বাদী যৌনকর্মী বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে খিলগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুজিত কুমার সাহা বলেন, ওই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাদীর অভিযোগ মিথ্যা উল্লেখ করেছেন তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির খান।

পুলিশ সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালেরই ১৪ মার্চে মুন্সিগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, বড় ননদের স্বামীর (গণধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার রমজান আলী) বিরুদ্ধে যৌতুক ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে একটি মামলা করেন ওই নারী। আসামিদের অবস্থান সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ থানা এলাকায় কিন্তু বাদী মামলা করেন মুন্সিগঞ্জের আদালতে। ফলে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।

এদিকে মামলার বাদী জানান, কয়েক বছর পূর্বে কারিমুল ইসলামের সাথে পরিচয় হয় তার। ২০১৬ সালে তাকে বিয়ে করেন। প্রেমের সম্পর্কে পরিবারের অমতে বিয়ে করায় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। স্বামীর সাথে যাত্রাবাড়ি থানার পূর্ব জুরাইন এলাকায় থাকতেন। দুই বছর পূর্বে তার স্বামী কারিমুল তাকে ছেড়ে চলে যান। এরপরই তিনি আদালতে নারী নির্যাতনের অভিযোগে মামলাটি করেন।

ওই নারী বলেন, স্বামী চলে যাওয়ার পর থেকে আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে জুরাইনেই থাকছিলাম। মানুষের বাসায় কাজ করছি। এক মাস পূর্বে জানতে পারি আমার ছোট বোনকে নিয়ে পালিয়ে গেছে আমার স্বামী। তাকে আমি বিভিন্ন জায়গায় খুঁজছি। কয়েকদিন আগে সিরাজগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে যাই। সেখান থেকে জানতে পারি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থান করছে আমার স্বামী। ২৭ আগস্ট রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় আসার পর সাহেবপাড়া এলাকায় নিয়ে মহসিন ও রমজান আমাকে ধর্ষণ করে।

মামলায় ঘটনাস্থল হিসেবে সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন মিজমিজি সাহেবপাড়া নতুন রাস্তা ১ নম্বর রোডে জনৈক জসিমের নবনির্মিত চারতলা ভবনের নিচতলার একটি কক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মঙ্গলবার সরেজমিনে সিদ্ধিরগঞ্জের সাহেবপাড়া (উত্তর, দক্ষিন, পশ্চিম) এলাকায় প্রায় দুই ঘন্টা খুঁজেও ওই ঠিকানার বাড়ি কিংবা জনৈক জসিম নামে কোনো বাড়িওয়ালাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই এলাকার এক ফার্মেসির দোকানি বলেন, এই এলাকায় অন্তত ১৬০টি বাড়ি আছে। তবে সেখানে চারতলা বাড়ির মালিক জসিম নামে কেউ নেই।

এদিকে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইশতিয়াক আশফাক রাসেল বলেন, ঘটনার রাতে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে পুলিশকে জানালে একটি পেট্রোলিং টিম ওই এলাকা ঘোরার পরও লোকেশন পায়নি। পরে বাদীর দেওয়া তথ্যমতে মামলা নেওয়া হয়। বাদীর দেওয়া ঠিকানায় অভিযান চালিয়ে একজন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানান, মামলার বাদী গত বছরের জুনে খিলগাঁও থানায় একই রকম অভিযোগে ছয়জনকে আসামি করে একটি গণধর্ষণ মামলা করেছিলেন। ওই মামলায় তার স্বামীর ছোট ভাই ও বোনের স্বামীকে আসামি করা হয়। মামলাটির চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগটি মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন। আদালতেও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে একটি নারী নির্যাতন মামলা করেন। সেটিও খারিজ হয়ে গেছে। নতুন এই গণধর্ষণ মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।

এদিকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় করা গণধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার আসামি রমজান বলেন, ‘দুই বছর ধইরা আমার শালার সাথে ওই মেয়ের সম্পর্ক নাই। এখন শুনি তার ছোটবোনকে নিয়ে পালাইছে। স্বামীকে কোনোভাবেই ধরার সুযোগ পাইতেছে না। এখন আমার নামে কেস দিছে। বোনের জামাইকে ধরলি পরে শালাকেও পাওয়া যাবে এই মনে কইরা। এর আগেও সে এমন কাজ করছে।’

রজমানের স্ত্রী মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার স্বামী বাড়িয়ে ঘুমাইয়া ছিল। তারে ফাঁসানোর লাইগা এই মামলা করা হইছে। যে জীবনে কখনও ঢাকায় যায় নাই সে কেমনে ধর্ষণ করলো?’

মামলার বাদীর বাবার বাড়ি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায়। মুঠোফোনে বাদীর মা সাফিয়া বেগম জানান, বাদী তার সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে তিন নম্বর। তার আপন ভাতিজার সাথে সাত বছর পূর্বে বাদীর বিয়ে দিয়েছিলেন। ওই সংসারে তাদের একটি কন্যাসন্তান আছে। এরপর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পরে প্রেম করে কারিমুলকে বিয়ে করে বাদী। এরপর থেকে বাবার বাড়ির লোকজনের সাথে সম্পর্ক নেই তার। তবে মেয়ের করা দু’টি গণধর্ষণ মামলার কিছুই জানেন না বলে জানান মা সাফিয়া বেগম।

সাফিয়া বেগম বলেন, ‘দুই বছর কারিমুলের লগে মাইয়ার সম্পর্ক নাই জানি। গত মাসের ১৫ তারিখ থেকে আমার ছোট মেয়ে রুমা নিখোঁজ। ওই রাতেই বড় মাইয়া আইসা আমারে বলে তার স্বামী কারিমুল নাকি রুমারে নিয়া পালাইছে। এই কইয়া প্রথমে সিরাজদিখান থানায় এরপর যাত্রাবাড়ি থানায় নিয়ে যায়। যাত্রাবাড়ি নিয়ে আমারে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে, আমারে লাথিও দেয়। আমি নাকি জানি তার স্বামী কই আছে। আমি বলছি, তুমি মামলা কইরা আমার মাইয়ারে খুঁইজা দেও আর তোমার স্বামীরে নিয়া যাও। এরপর আমার সাথে আর কথা হয় নাই।’

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ফারুক বলেন, ‘বাদীর মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়েছে। সে ধর্ষণ হয়েছে কিনা তা রিপোর্ট পাওয়া গেলে বলা যাবে। মামলার সাথে আসামিরা সম্পৃক্ত না থাকলে তারা চার্জশিটে অব্যাহতি পাবেন। বাদীর অভিযোগ মিথ্যা পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়