২৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ১৮:২০, ১৬ নভেম্বর ২০১৭

আপডেট: ১৫:৫৬, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮

কালের সাক্ষী বোস কেবিন

কালের সাক্ষী বোস কেবিন

আল-আমিন শান্ত নীল (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়, কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার দায়! গানটা কবীর সুমনের কিন্তু ঠিক মিলে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের শতায়ু বোস কেবিনের সাথেও! বোস কেবিনের বয়স প্রায় ১০০ বছর, ভাবা যায়!

কালে কালে দেশ বদলেছে, বদলেছে শাসন ব্যবস্থা। কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে আছে বোস কেবিন। শুরুটা ১৯২১ সালের দিকে। নৃপেন চন্দ্র বসু‘র (ভুলুবাবু) নাতি বোস কেবিনের বর্তমান মালিক তারকনাথ বসু বলেন, তারা হয়তো এই জায়গায় বাণিজ্যিক ভবন তৈরী করে অনেক টাকা উপার্জন করতে পারতেন; কিন্তু তাঁরা তা করেননি শুধুমাত্র তাঁদের এই বংশ পরম্পরায় চলতে থাকা ব্যবসায়িক ঐতিহ্যের জন্য। 

নৃপেন চন্দ্র বসু (ভুলুবাবু) জন্মসূত্রে বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলা তৎকালীন বিক্রমপুরে ষোলঘরে জন্মগ্রহণ করেন। লেখাপড়ার দিক থেকে এন্ট্রান্স পাস করেছিলেন কিন্তু এন্ট্রাস পাশ করেও নৃপেন চন্দ্র বসু (ভুলুবাবু) কোন তাগিদে এই পেশায় যুক্ত হলেন? 
সময়টা তখন ১৯০৫; বঙ্গভঙ্গ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে ১৯১১-তে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন প্রত্যেকটা বাঙালির কাছে অবধারিত হয়ে দাঁড়িয়েছিলো আর সেটার প্রভাবেই প্রভাবিত হয়ে ভুলুবাবু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পরোক্ষভাবে নিজেকে সামিল রাখার জন্যই হয়তো এন্ট্রাস পাস করেও একটি চায়ের টং দোকান নিয়ে সাথে লাঠি বিস্কুট এর ব্যাবসা করতে বসলেন।

বোস কেবিন নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ ঘাট আর রেল স্টেশনের কাছেই ছিলো। তখন কলকাতায় যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছিলো; আর সেই উত্তাল প্রতিরোধের উত্তুঙ্গ হাওয়ার জোয়ার পূর্ব বঙ্গে বা নারায়ণগঞ্জে আসতো মূলত চিঠির মাধ্যমে। আর এই চিঠির আদান-প্রদান হতো ভুলুবাবুর বোস কেবিন মাধ্যমেই।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু নারায়ণগঞ্জ এসেছিলেন। আর সে সময় আটক হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ পুলিশের হাতে। খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন ভুলুবাবু। তবে খালি হাতে যাননি এই দেশপ্রেমী মানুষটি সাথে নিয়েছিলেন বিদ্রোহী নেতার জন্য তাঁর বানানো চা। কোন ধরনের চা নেতাজির পছন্দ হবে সেই সংশয়ে না থেকে দুই ক্যাটলিতে দুই রকম স্বাদের চা বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কড়া লিকার আর হালকা লিকারের চা। নেতাজি তার চা পান করে আশির্বাদ করে বলেছিলেন, "তুমি একদিন ভালো করবে, বড় হবে।" 


বংশীয় পদবী অনুসারেই ভুলুবাবুর ছোট্ট চায়ের দোকানটির নাম রাখা হয়েছিলো "নিউ বোস কেবিন"। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সফলভাবে শেষ হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার প্রথম দিকে বোস কেবিনে হোসেন শহীদ সোহারাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এরা সবাই এসেছেন ।

সেই সময়েও ৫২‘র ভাষা আন্দোলন, ৭১‘র স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বড় মাপের মানুষগুলো পা রেখেছিলেন এই বোস কেবিনে। ভুলুবাবুর বোস কেবিন স্মৃতির পাতা ভারি করেছিলো বড় বড় সম্মানিত সুধীজনদের আপ্যায়ন করে।
বোস কেবিনের সবচেয়ে পুরাতন লোক গোপীদা। ১৯৭১ সালে ৬ টাকা নিয়মিত আয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। আজ তাঁর রোজ দাড়িয়েছে ৩০০ টাকায়। এমন একজন মানুষ যে কিনা তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছেন এই বোস কেবিনে। বোস কেবিনের প্রায় ৩০ বছরের চায়ের কারিগর মতি বোসকে এখন সারাদিনে প্রায় হাজার কাপ চা বানাতে হয়।

এখানকার সকাল এবং বিকেলের নাস্তা তো এ অঞ্চলের মানুষের কাছে বিখ্যাত। সব মিলিয়ে শুধু চায়ের জন্য নয় খাবারের জন্যও বিখ্যাত বোস কেবিন। বোস কেবিনে সকালের নাস্তায় পাওয়া যায় পরোটা, দাম ৫ টাকা। ডাল ও হালুয়া ৮ টাকা। ডিমের ৬ রকমের পদ ছাড়াও পাওয়া যায় খাসি মুরগির মাংস।

দুপুর ১২টা থেকে পাওয়া যায় আলুর চপ দাম ১৫ টাকা। পোলাও ৪০ টাকা। মোরগ পোলাও ৮০ টাকা। কারি ৮০ টাকা। চিকেন কাটলেট ৭০ টাকা। এখানে দুপুরে ভাত বিক্রি হয় না।

নেতাজি যে চা খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন, কড়া লিকারের সেই চা বড় কাপে পাওয়া যাবে মাত্র ১২ টাকায়। সবসময় এখানে চা পাওয়া যায়। এখানে অনেকে  আসেন কেবল কাটলেটের স্বাদ নিতে। বোস কেবিনের কাটলেট এক কথায় অসাধারণ। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে বোস কেবিন। ছুটির দিনগুলোতে এখানে তিল ধারণের জায়গাও থাকে না।
৬০ বছর ধরে আড্ডা দেওয়া অবসরপ্রাপ্ত সোনালী ব্যাংকের এজিএম এম. তরিকত হোসেন (৭৬) আক্ষেপ করে বলছিলেন, বোস কেবিনের সেই পরিবেশ আর নেই। এ স্থানটা ছিল নীরব গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ আড্ডাস্থল। কিন্তু এখন বিভিন্ন শ্রেণির আগত মানুষের শোরগোলে খাবারের অর্ডার দেওয়ার শব্দ দূষণ ও বাহ্যিক আচার-আচরণ বর্তমানে বোস কেবিনের ইতিহাসের সঙ্গে অত্যন্ত বেমানান।

বোস কেবিনে প্রথম আগমনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৫৮ সালে কলেজে ভর্তি হই। সেই সময় দুই আনা দিয়ে চা খাওয়া শুরু করেছি। সেই যে প্রেমে পড়লাম বোস কেবিনের। এখন এক কাপ চা ১২ টাকা।
নারায়ণগঞ্জের কবি সাহিত্যিক রাকিবুল রকি জানালেন, বোস কেবিন নারায়ণগঞ্জ সাহিত্য সংস্কৃতি, রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি পরিচিত নাম। কলকাতার যেমন কফি হাউজ, বাংলা বাজারের যেমন বিউটি বোডিং, নারায়ণগঞ্জে তেমনি বোস কেবিন।

এপার বাংলা, ওপার বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে জড়িত এমন কেউ নেই যার পদচিহ্ন বোস কেবিনে পড়েনি। বোস কেবিন নারায়ণগঞ্জের গর্ব। বোস কেবিন নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্য। তবে বর্তমানে বোস কেবিনে তরুণদের উপস্থিতি খুবই কম। প্রবীণদের সাথে বোস কেবিনে নবীনদের মেলবন্ধন ঘটাতে না পারলে বোস কেবিন তার স্বীয় ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারবে না।

আহমদ ছফার কাব্যগ্রন্থ একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনায় ছফা বলেন, ’পিতামহ বনস্পতি; বিনীত সন্তানে তুমি দাও এই বর, সুক্ষ্ম শরীর ধরে এই মাঠে-যেনো আমি বেঁচে থাকি অনেক বছর। 

শতায়ু বোস কোবিন, বেঁচে থাকুক।

রাহাত হোসাইন খান

সর্বশেষ

জনপ্রিয়