২৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২০:০৬, ৩০ এপ্রিল ২০২১

মহান মে দিবস: শ্রমিকের রক্তে লেখা সংগ্রামের ইতিহাস

মহান মে দিবস: শ্রমিকের রক্তে লেখা সংগ্রামের ইতিহাস

এম এ শাহীন: ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। মহান এই দিনটি সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ যথাযথ মর্যাদার সহিত উদযাপন করে। আমাদের দেশেও সভা-সমাবেশ এবং মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রমিক মেহনতি মানুষ ১ মে দিবসটি উদযাপন করে। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকরা ৮ ঘন্টা কর্মদিবস, ন্যায্য মজুরি ও অধিকার আদায়ের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধর্মঘট আহবান করে। যার মধ্য দিয়ে রচিত হয় শ্রমিক শ্রেণির এই ঐতিহাসিক লড়াই সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

১ মে ধর্মঘট সফল করতে শিকাগো শহরের ৩ লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ বন্ধ রেখে মিচিগান এভিনিউয়ে এক বিশাল শ্রমিক সমাবেশে মিলিত হয় যা মালিক গোষ্ঠীর ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিন শান্তিপুর্ণ ভাবে ও সাফল্যের সাথে কর্মসূচি পালিত হয়। এই সাফল্য থেকে আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষ নতুন করে প্রেরণা লাভ করে। আর শিকাগোর ১ লক্ষ্য ২৫ হাজার শ্রমিক বিশেষ করে নির্মাণ শ্রমিকরা ৮ ঘন্টা কাজের দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়। পরের দিন ২ মে কারখানার ধর্মঘট শ্রমিকদের সভায় মালিক গোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া গুন্ডা বাহিনী ও পুলিশ বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে দুই জন শ্রমিককে হত্যা ও অনেককে আহত করে। যার প্রেক্ষিতে ৩ মে ধর্মঘট আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। মালিক শ্রেণি শ্রমিক ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য দালাল শ্রমিক নেতাদের দিয়ে চেষ্টা চালায়। শ্রমিকদের আন্দোলন দমাতে শাসকগোষ্ঠী একটা কিছু করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। সেদিন ম্যাককর্মিক ফসল কাটার কারখানায় শ্রমিকরা এক সভায় মিলিত হলে সভা চলাকালীন সময়ে পুলিশ অতর্কিতে শ্রমিক সভায় গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে ৬ জন শ্রমিক নিহত ও অনেক শ্রমিক আহত হয়। এই নৃশংস হত্যাকান্ড যেখানে হয় তার পাশেই একটি সভায় শ্রমিক নেতা স্পাইজ বক্তৃতা কর ছিল। গুলি বর্ষণের খবর পেয়ে সহকর্মীদের সাথে পরামর্শ করে তিনি তাতক্ষণিক ভাবে এই পাশবিক হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে ৪ মে হে-মার্কেটে প্রতিবাদ সভা আহবান করে। এই জঘন্যতম হামলা ও হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ৪ মে শ্রমিকরা হে-মার্কেটের স্কোয়ারে সভায় মিলিত হলে সেখানেও পুলিশ আবার আক্রমণ করে। তখন শান্তিপুর্ণ সভা বিদ্রোহ করে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আক্রমণ গড়ে তোলে।

সেদিন আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষ তাদের সকল শিল্পাঞ্চলে যে সংগ্রাম গড়ে তুলে ছিলো সেই সংগ্রামে অসংখ্য শ্রমিক আহত-নিহত হয়। শ্রমিক নেতা স্পার্সনস, স্পাইজ, ফিসার ও এঙ্গেলস কে মিথ্য মামলা দিয়ে নির্বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। আর শিকাগোর সংগ্রামী শ্রমিক নেতাদের কারাগারে প্রেরণ করে মালিক শ্রেণি। গুন্ডা দিয়ে পুলিশ দিয়ে হামলা চালিয়ে নির্যাতন করে, গুলিকরে হত্যাকরে, গ্রেফতার করে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে শ্রমিক নেতাদের ফাঁসি দিয়েও সেদিন শ্রমিক আন্দোলন দমন করতে পারেনি। বরং এই অন্যায় অত্যাচার ও প্রহসনের বিচারের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীতে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এই ঘটনা তখন আর আমেরিকায় সীমাবদ্ধ ছিলো না সারাদুনিয়ার দেশে দেশে তা ছড়িয়ে পরে। হে-মার্কেটে রক্তাক্ত শ্রমিকের রক্তে সৃষ্ট রক্ত পতাকা সংগ্রামী প্রতীক লাল পতাকা এক দেশ থেকে আরেক দেশে বিশ্বময় শ্রমিক শ্রেণীর কাছে পৌঁছে গেল। সেই থেকে লাল পতাকা হাতে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম এগিয়ে যেতে থাকে। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণী তার ৮ ঘন্টা কর্মদিবস, ন্যায্য মজুরি ও অধিকার আদায় করতে সক্ষম হয়। পরবর্তিতে ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বিশ্বের সমাজতন্ত্রীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্তগৃহীত হয়। যারপর থেকে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের মধ্যদিয়ে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে পরিণত হয়। এই দিনে সারা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণী সভা সমাবেশ মিছিল এবং নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরে। পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে মুক্তির জন্য বিপ্লবী ধারার লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করে। বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি সংহতি ঘোষণা করে। "দুনিয়ার মজদুর এক হও" শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে। তবে এবার করোনা মহামারীর কারণে নারায়ণগঞ্জসহ সারাদেশে মে দিবস উদযাপন একটু ভিন্ন আঙ্গিকে হবে। শ্রমিকরা সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে স্বল্প পরিসরে কারখানার সামনে বা রাস্তার মোরে কিংবা ঘরোয়া পরিবেশে আলোচনা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে। এই দিনটিকে আমাদের দেশে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির উদ্দেশ্যে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আদর্শ হিসেবে নিতে হবে।

যে লক্ষ্য নিয়ে মে দিবস ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল তা আজও আমাদের দেশের শ্রমিকরা অর্জন করতে পারেনি। মে দিবসের ১৩৫ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও এদেশের শ্রমিকরা মে দিবসের সুফল পায়নি। তারা আজও ৮ ঘন্টা কাজ, ন্যায্য মজুরি ও অধিকার বঞ্চিত, শোষিত-নির্যাতিত এবং অগণতান্ত্রিক কালাকানুনের শৃঙ্খলে বাঁধা পরে রয়েছে। শুধু তাই নয় বৈশ্বিক মহামারী করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেও মালিকরা শ্রমিকদের দায়িত্ব নেওয়ার পরিবর্তে ছাঁটাই-বরখাস্ত ও কারখানা লে-অফ করে দিয়ে তাদেরকে বেতন-ভাতা ও আইনি পাওনা থেকে বঞ্চিত করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এটাই প্রমাণ করে যে সু-সংগঠিত শক্তি প্রদর্শন তথা বিপ্লবী ধারার শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলা ছাড়া শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। পূঁজিবাদী ধনীক শ্রেণীর শাসন ব্যবস্থা শ্রমিক আন্দোলনকে ধ্বংস ও বিপথে পরিচালিত করার জন্য রাষ্ট্রের পুলিশ, বিজিবিসহ সর্বশক্তি ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না। পূঁজিবাদের এই হিংস্রতম কৌশলী আক্রমণের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীকে রুখে দাঁড়াতে হবে। এই বিশাল শক্তিকে মোকাবেলা করতে প্রয়োজন শ্রমিকের ঐক্য ও শক্তিশালী সংগঠন। শ্রমিকের রক্তে লেখা ঐতিহাসিক সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে `মে দিবসে এদেশের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শোষণ মুক্তির শপথ নিতে হবে। সারাদুনিয়ার সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ যে ৮ ঘন্টা শ্রম সময় ভোগ করছে তা ঐ মহৎ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস খ্যাত মে দিবসের ফসল। এই প্রাপ্তি শুধু শ্রমজীবী জনগণই ভোগ করছে না সকল মানুষের মাঝেই তা বন্টিত হয়েছে। সকলেই ৮ ঘন্টা শ্রম অধিকার এবং সেই সাথে শ্রমিক শ্রেণীর লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত নানা ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারগুলোও ভোগ করছে। সেই জন্য ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের দাবি শুধু শ্রমিকদের সংকীর্ণ শ্রেণী স্বার্থের দাবি ছিলো না বরং তা ছিলো এক মানবিক কর্মপরিবেশ ও সার্বজনীন অধিকারের অনুরণন। যার ফলে শ্রমজীবী মানুষের শোষণ মুক্তির সংগ্রাম এক নতুন প্রেরণা লাভ করে। তাই সারা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষ মে দিবস পালনের মাধ্যমে "মে" শহীদের স্মৃতিকে চিরঞ্জীব করেছে। মহান মে দিবসে সেই মহৎ ঐতিহ্যের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জনাই।

লেখক: এম এ শাহীন

সভাপতি, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জ জেলা

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়