২৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রেস নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ১৮ মার্চ ২০২৪

মাইকে ঘোষণার পর পিটুনিতে অংশ নেয় কয়েকশ’ গ্রামবাসী

মাইকে ঘোষণার পর পিটুনিতে অংশ নেয় কয়েকশ’ গ্রামবাসী

কয়েকশ’ একরের বিস্তীর্ণ বিল। স্থানীয়ভাবে এটি ‘বড়বিল’ বলে পরিচিত। বিলের চারপাশে তিনটি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম। গত রোববার রাতে ডাকাতির উদ্দেশ্যে কয়েকজন ব্যক্তি বিলে অবস্থান নিয়েছে; স্থানীয় একাধিক মসজিদে এমন ঘোষণায় আশেপাশের গ্রামের কয়েকশ’ ব্যক্তি ধাওয়া দিয়ে পাঁচজনকে গণপিটুনি দেন। তাদের মধ্যে চারজন মারা গেছেন, গুরুতর জখম নিয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরও একজন। রোববার রাতের এই ঘটনার পর সোমবার স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

হতাহতদের মধ্যে দুইজনের পরিচয় এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তারা হলেন- সোনারগাঁ উপজেলার রাজাপুর শেখেরহাট গ্রামের আমান উল্লাহ’র ছেলে জাকির হোসেন (৩৬) এবং আড়াউহাজার উপজেলার জালাকান্দি গ্রামের নুরু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ আলী (৩০)।

জাকিরের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গে রয়েছে এবং মোহাম্মদ পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

সোনারগাঁ থানা পুলিশ জানায়, রাত সাড়ে ১১টার দিকে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনির খবর পান তারা। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (‘খ’ সার্কেল) বিল্লাল হোসেনের নেতৃত্বে বড়বিলে গিয়ে বাঘরী গ্রামের অংশ থেকে একজনকে মৃত এবং দুইজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় পান। আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে মারা যান। অপরজনকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন। পরে সকালে বিলের সুখেরটেক গ্রামের অংশ থেকে আরও দুইজনের লাশ পাওয়া যায়।

স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত বৃহস্পিতবার দিবাগত রাতে কাজরদী গ্রামে এক বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ওই সময় এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে আহত করে ডাকাতদলের সদস্যরা। এতে গ্রামবাসী ছিল ক্ষুব্দ। রোববার রাতে কয়েকজন ব্যক্তিকে বিলে সন্দেহজনক অবস্থায় দেখতে পেয়ে আশেপাশের একাধিক গ্রামের মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে গ্রামবাসী দেশীয় ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে ধাওয়া দিয়ে কয়েকজনকে ধরতে পেরে গণপিটুনি দেয়।

সুরতহালে হতাহতদের শরীরে শাবল, টেঁটাসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্নও পাওয়া গেছে। তবে ঘটনাস্থলে কোন প্রকার বা লাঠিসোটা পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় একটি স্টিলমিলের শ্রমিক বলেন, রাত সোয়া দশটার দিকে মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা শুনে তিনি বিলে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন কয়েকশ’ গ্রামবাসী বিলের মধ্যে ‘ডাকাতদলের’ সদস্যদের খুঁজছে। পরে একজনকে খুঁজে পেয়ে তাকে লোকজন মারধর করে। বিলের অন্যপাশেও আরও কয়েকজনকে পেয়ে মারধর করেন গ্রামবাসী।

‘গ্রামবাসী যে যা পাইছে তা হাতে নিয়া বিলে নামছে। ওইগুলা দিয়াই মারছে। ওরা (মারধরের শিকার ব্যক্তিরা) খালি গায়ে ছিল, পরনে শুধু হাফপ্যান্ট ছিল। তাগো হাতে কোন অস্ত্র দেখি নাই।’

বাঘরী গ্রামের লেবুরটেক জামে মসজিদের ইমাম জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘তারাবির নামাজ শেষ হওয়ার পর আমি তখন মসজিদেই ছিলাম। গ্রামবাসী এসে এই মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়েছে বলে এনাউন্স করে। এর আগে আরও দুই-তিনটা মসজিদ থেকে ডাকাতের বিষয়ে মাইকে বলে। লোকজন তখন বিলে নামে ডাকাত খুঁজতে।’

রাতে লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশের সাথে ছিলেন কাঁচপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘আহত অবস্থায় ডাকাতদলের এক সদস্য পুলিশের কাছে ভিডিওতে জবানবন্দি দিয়েছিল। ওই সময় সে জানায়, “মদনপুরের নাজিম উদ্দীন ভূঁইয়া কলেজের সামনে দিয়ে বিলে যান তারা। বানিয়াবাড়ি গ্রামের একটি বাড়ি তাদের টার্গেট ছিল। এইজন্য বিলের উচু এক ভিটিতে তারা প্রায় সাতজন জড়ো হয়েছিল, আরও কয়েকজনের আসার কথা ছিল। এরমধ্যেই মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা শুনে গ্রামবাসী বিলে নেমে পড়লে দৌঁড়ে তারা পালানোর চেষ্টা করে।”’

‘মাইরের ঘটনার সময় বিলের মধ্যে বানিয়াবাড়ি, বাঘরী, কাজরদী, সুখেরটেকসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষই ছিল। কিন্তু যখন পুলিশ বিলে যায় তখন কেউই ছিল না’, যোগ করেন জাকির।

এদিকে, নিহতদের মধ্যে জাকির হোসেনের নানাবাড়ি কাঁচপুর ইউনিয়নের সুখেরটেক গ্রামে। বড়বিল থেকে তার নানাবাড়ি দুই কিলোমিটার দূরে।
দুপুরে সুখেরটেক গ্রামে জাকিরের নানিবাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। নানা ও নানি মারা গেছেন কয়েকবছর আগে, ছোটমামার ঘরটিও ছিল তালাবদ্ধ।

প্রতিবেশীরা জানান, জাকির নানাবাড়িতেই বড় হয়েছেন। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পরে তিনি এই গ্রামে আর থাকেন না। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে আড়াইহাজার উপজেলায় থাকেন। জাকিরের বিরুদ্ধে আগেও ডাকাতির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ শুনেছেন বলে জানান স্থানীয়রা।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও প্রাথমিক তদন্তের বরাতে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (‘খ’ সার্কেল) শেখ বিল্লাল হোসেন জানান, জাকির সোনারগাঁয়ের ডাকাতদলের সর্দার। তার এক মামাও পুলিশের তালিকাভুক্ত ডাকাতদলের সদস্য। চিকিৎসাধীন মোহাম্মদ আলীর জবানবন্দি ও প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে জাকির হোসেনের নেতৃত্বে রোববার রাতে তারা কয়েকজন ডাকাতির উদ্দেশে ওই বিলে জড়ো হয়েছিল।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এর আগে ২০২২ সালের তিন মার্চ উপজেলার সাদীপুরের নানাখী গ্রামে ডাকাতি করতে গিয়ে দুই সঙ্গীসহ গণপিটুনির শিকার হন জাকির। পরে গত বছর উপজেলার মহজমপুর গ্রামে এক পুলিশ পরিদর্শকের বাড়িতে ডাকাতি করার পর গ্রেপ্তার হন তিনি। ২০১৬ সালেও ওই বিলে ডাকাত সন্দেহে গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে এক ব্যক্তি নিহত হন।

শেখ বিল্লাল হোসেন বলেন, পিটুনিতে চারজনের মৃত্যু এবং একজন আহত হওয়ার ঘটনাটি তদন্ত করছে পুলিশ। এই বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দুপুরে বাঘরদী গ্রামে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দলকে দেখা যায়। সংস্থাটিও এই ঘটনার ছায়াতদন্ত করছে বলে জানান সিআইডি’র নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের পুলিশ সুপার হুমায়ূন কবির।

তবে, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত এই ঘটনায় থানায় কোন মামলা হয়নি।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়