৩০ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ১১ এপ্রিল ২০১৯

শুভ নববর্ষ: বাঙালি জাতির অম্লান অলংকার

শুভ নববর্ষ: বাঙালি জাতির অম্লান অলংকার

প্রেস নারায়ণগঞ্জ: বাংলা ভাষা যেমন আমাদের সম্পদ তেমনি বাংলা সন এবং নববর্ষও আমাদের জাতীয় সম্পদ। পৃথিবীর যে কোন জাতির পূর্ণাঙ্গতার স্বীকৃতির অন্যতম উপাদান হচ্ছে তার নিজস্ব দিন পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার। আমাদের অহংকার এই বাংলা সন, যার নববর্ষের সুতায় বাঙালী জাতিকে বেঁধে দিয়ে এক্ষেত্রে শাহেনশাহ্ আকবর চিরদিন বাঙ্গালী জাতির কাছে অম্লান হয়ে আছে। বাংলা সন হলো আমাদের জাতির একটি অলংকার, যা আমাদের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত, একে যারা টেনে তুলতে চান তারা হয়তো বাংলা সনের ইতিহাস জানেন না অথবা তারা মানব সভ্যতার ইতিহাসকে টেনে ছিঁড়ে ফেরত চায়। মানুষের হৃদপিন্ড ছিড়ে ফেললে মানুষ বাঁচে না, মানুষ মরে যায়। ঠিক তেমনি বাঙালী জাতির সংস্কৃতির হৃদপিন্ড ছিঁড়ে ফেললে বাঙালী জাতি মরে যাবে। এরা হয়তো অন্য কোন প্রতিহিংসা জায়েয করার জন্যই বাঙালীর এই সংস্কৃতিকে তাদের বিষ দাঁতের সকল বিষ ঢেলে দিতে চায় শুভ নববর্ষের অনুষ্ঠানে। নববর্ষ আমাদের প্রাণে এক নতুন আলো সঞ্চালিত হয়। হৃদয়ে প্রস্ফুটিত হয় বন্ধুত্বের অবগাহন। আমাদের চারপাশে একদল লোক আছে তারা না জেনে না বুঝে আমাদের প্রজন্মকে ভুল বুঝাতে অযথা নববর্ষের আয়োজন-অনুষ্ঠানের ভুল ব্যাখ্যা প্রচার করে থাকেন। একারণেই বাংলা নববর্ষের জন্মকথা আমাদের সকলেরই অবহিত হওয়া দরকার।

১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দ এবং আরবি সন হিজরী ৯৬৩ সন থেকে বাংলা সনের পদযাত্রা শুরু। চলতি ২০১৯ খ্রীঃ বাংলার সনের বয়স ৪৬৩ বছর। অনেকের কাছে প্রশ্ন জাগতে পারে সনের আবার বয়স কেমন করে হয়। ২য় মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পরে পুরনো মোঘল গোত্রগুলোর মধ্যে দিল্লির সিংহাসন দখল করা নিয়ে তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে উঠে। যুবরাজ আকবর উত্তরাধিকারী ভাবে সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহনের পূর্বে তাকে হত্যা করার এক গোপন ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে মা হামিদা বেগম ও ফুফু গোলবদল এক গভীর রাতের অন্ধকারে যুবরাজ আকবরকে নিয়ে ছদ্মবেশে প্রাসাদের গুপ্ত পথ দিয়ে বাহির হয়ে পড়েন। অতঃপর প্রধান সেনাপতি বৈরাম খার অনুগত সৈনিক বেষ্টিত হয়ে দিল্লির দূরবর্তী এক জঙ্গলের ভিতর শিবিরে অবস্থান নেয়। সেখানেই ইটের তৈরি সিংহাসন বানিয়ে আকবরকে সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত করা হয়। অতঃপর বিশ্বস্ত সেনাপতি বৈরাম খার বিচক্ষনতায় আকবর পুনরায় ১৩ বছর বয়সে রাজকীয় আড়ম্বরে দিল্লির মসনদে আসিন হন।

সাহসী যোদ্ধা, সম্রাজ্য বিস্তার, সুদক্ষ শাসন কার্য্য, সংস্কৃতির প্রসার, সাধারণ মানুষের জীবন মান উন্নয়নের রাজ্য শাসনে বৈচিত্রময় ৩০ বছর অতিবাহিত হলে সম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে খাজনা আদায় ও দরবারের কার্য পরিচালনায় সন তারিখের হিসাব নিয়ে বিদঘুটে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ ভারত বর্ষে তখন নানা প্রকার সনের প্রচলন ছিল, যেমনঃ ভারত সন, বিক্রম সন, শালীবাহন সন, জালালী সন, গুপ্তাব্দ, লক্ষন সন ইত্যাদি এদের অধিকাংশই ছিল চন্দ্র সন। চন্দ্র মাসে ৩০টি তিথি থাকে, তিথি গুলির প্রত্যেকটিকে এক একটি চান্দ্র দিন বলা হয়ে থাকে। এক পূর্নীমা থেকে অন্য আমাবস্যা অথবা এক অমাবস্যা থেকে অন্য পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়ের নাম চন্দ্র মাস। চন্দ্রের বর্ষ পরিক্রমার হিসাব অনুযায়ী চন্দ্র সন গণনা করা হয়। সাধারণত ৩৫৪ দিন ৯ ঘন্টায় এক চন্দ্র বৎসর হয়।

আরবী হিজরী সনও এইরুপ একটি চন্দ্র সন। হযরত মোহাম্মদ (স.) কুরাইশদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজ জন্মভূমি মক্কা নগরী ছেড়ে মদিনাতে প্রত্যাবর্তন করেন। মক্কা থেকে মদীনা অভিমুখে এই অভিযাত্রা বা প্রত্যাবর্তনকে আরবী ভাষায় হিযরত বলা হয়ে থাকে। নবীর হিযরতের স্মৃতি রক্ষার্থে এই সন প্রচলন হওয়াতে তাকে হিজরী সন বা আরবী সন বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে সূর্যের বার্ষিক গতি অনুযায়ী সৌর সন গণনা করা হয়ে থাকে। সূর্যের রাশী চক্র অতিক্রমের সময় লাগে ৩৬৫.৬ ঘন্টা অর্থাৎ চন্দ্র সন থেকে সূর্য সন ১১ দিন বেশী।

মোঘল আমলে রাজ দরবারে হিজরী সনের প্রচলন ছিল। এই হিজরী সন অনুযায়ী কোন নির্দিষ্ট দিনে প্রজাদের খাজনা পরিশোধের দিন ধার্য্য করে দিলে প্রতি বারই এই সন সরে যেতে থাকে, অথচ ফসল তোলার সময় বা প্রাকৃতিক ঋতু সরে যায় না। যার কারণে প্রজাদের খাজনা আদায় ও দরবারে কার্য পরিচালনার দিন তারিখ নিয়ে বিভ্রাট সৃষ্টি হয়। এই জটিলতা দূরিকরণে সম্রাট আকবরের রত্ন সভা সদস্য ফতেউল্লাহ কে হিজরী সন, ফসলী মৌসুম এবং ভারতে প্রচলিত নানা প্রকার চান্দ্র সনের সমন্বয়ে একটি সৌর সন তৈরির নির্দেশ দেন।

আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবর এমন একটি ত্রুটিমুক্ত ও বিজ্ঞান সম্মত সৌরসনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্যই একটি সাবলিল সুন্দর সন হতে পারে।

সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের হিজরী সন ছিল ৯৬৩ সন। এই হিজরী সনকেই সৌর সনে পরিবর্তন করে বাংলা সনের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। যার কারণে বাংলা সন পর্যায়ক্রমে গণনা শুরু হয় ৯৬৪, ৯৬৫ এভাবে আজ ১৪২৬ সন। বাংলা সনের বৈশিষ্ট এই যে, এখানে সৌর জন ও চন্দ্র সম্মিলিত হয়ে এক অভিনব সনের জন্ম দিয়েছে।

সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের কাল ১৫৫৬ ইংরেজী সন ২০১৯ থেকে বাদ দিলে (২০১৯-১৫৫৭) = ৪৬৩ বছর আর এর সঙ্গে হিজরী ৯৬৩ যোগ দিলে ৯৬৩+৪৬৩ = ১৪২৬ বাংলা সন। আরেকটি ব্যাপার হলো ইংরেজীতে সৌর সন ১৪ এপ্রিল এর সঙ্গে বাংলা সনের প্রথম তারিখ ১লা বৈশাখকে এমন অপরূপ সমন্বয় করা হয় যে, বাংলা সন ঘুরে-ফিরে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিলে শুভ নববর্ষ এসে মিলন ঘটাবে।

ভাষাবিদ ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লা বলেছেন, আমরা হিন্দু বা মুসলিম যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়। এটি একটি বাস্তব কথা। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় এমন ছাপ মেরে দিয়েছে, যে তা মালা, তিলক, টিকিতে, কিংবা টুপি, লুঙ্গি ও দাঁড়িতে ঢাকবার জো’টি নেই। নববর্ষ অনুষ্ঠানে আমাদের সকলের জন্য নুতন দিন বয়ে নিয়ে আসুক, দুর হউক হিংসা, বিদ্বেশ, শুভ নববর্ষ।

লেখক: এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইল, রাজনীতিক ও আইনজীবী

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়