২৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ১৯:৪৬, ৪ ডিসেম্বর ২০২২

আপডেট: ২০:০৬, ৪ ডিসেম্বর ২০২২

নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধে যাত্রীরা বিপাকে

নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধে যাত্রীরা বিপাকে

সৌরভ হোসেন সিয়াম (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): নারায়ণগঞ্জে বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন গৃহিনী সুরাইয়া ইসলাম। গাজীপুরের জয়দেবপুরে তার শ্বশুরবাড়ি। এসেছিলেন ট্রেনে, ফেরারও কথা ছিল ট্রেনেই। কিন্তু দুপুর ১২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় রেল স্টেশনে এসে জানতে পারেন ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য’ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ। বাধ্য হয়ে আবারও বাবার বাড়িতে ফিরে যান সুরাইয়া।

তিনি বলেন, “জয়দেবপুর থেকে ট্রেনে ঢাকার কমলাপুর এবং সেখান থেকে নারায়ণগঞ্জ; এভাবেই সবসময় যাতায়াত করি। সপ্তাহখানেক থাকার পর বাসায় ফিরতেছিলাম। আজ যে ট্রেন বন্ধ জানতাম না। বাসে কখনও একা যাইনি। রুটও চিনি না। কিছু করার নেই, বাবার বাসাতেই ফিরে যেতে হবে।”

কথা শেষ না হতেই বাবার বাড়িতে ফোন দেন ওই নারী। অপরপ্রান্তে জানান, ট্রেন বন্ধ, তিনি বাড়িতেই ফিরছেন। এরপর স্টেশন ছাড়েন সুরাইয়া।

শুধু সুরাইয়া ইসলাম নন, তার মতো হাজারো যাত্রী ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধে বিপাকে পড়েছেন। সময় ও অর্থ সাশ্রয়ে ঢাকা যেতে দীর্ঘবছরের পুরোনো এই রেলপথটি ব্যবহার করেন অনেকে।

তবে রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে গেন্ডারিয়া অংশে তিনটি পৃথক রেললাইনের নির্মাণকাজ ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য রোববার (৪ ডিসেম্বর) থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের ট্রেন চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু না জানালও অন্তত তিন থেকে সাড়ে তিনমাস ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে বলে জানাচ্ছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা।

চাষাঢ়া রেলস্টেশনেও কথা হয় কয়েকজন যাত্রীর সাথে। স্টেশনটির অদূরে দু’টি সরকারি কলেজসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই স্টেশনটিতে তাই প্রতিদিন সকাল ও দুপুরে শিক্ষার্থীদের বড় একটি চাপ থাকে। অল্প ভাড়ায় দ্রুত পৌঁছানোর জন্য ট্রেন ব্যবহার করেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, পাগলাসহ ঢাকার গেন্ডারিয়া, শ্যামপুরের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে কিংবা নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় পড়তে যাওয়া অনেক শিক্ষার্থীই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করা ট্রেনে নিয়মিত যাতায়াত করেন। ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে বলে জানান।

রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মিনজুমা ইসলাম বলেন, তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। সপ্তাহে পাঁচদিন শহরের কলেজরোড এলাকায় কোচিং পড়তে আসেন। প্রতিদিনই ফতুল্লা স্টেশন থেকে ট্রেনে যাতায়াত করেন। কলেজে যেতে হলেও ট্রেনে কমলাপুর হয়ে যান।

“টাকা ও সময় কম লাগে। এই কারণে ট্রেনেই যাতায়াত করি। ফতুল্লা থেকে ট্রেনে ১৫ টাকায় চলে আসি চাষাঢ়ায়। আইডি কার্ড সাথে থাকলে স্টুডেন্ট হিসেবে টাকাও লাগে না। আজকে আসতেই ৫০ টাকা খরচ হয়েছে। যেতেও তাই হবে। তার উপর রাস্তায় জ্যাম, ধুলাবালি তো আছেই।”

প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করে এই রুটে ট্রেন চলাচল শুরু করার দাবি জানান এই শিক্ষার্থী। এত ব্যস্ত একটি রুটে বিকল্প ব্যবস্থা রেখে কাজ শুরু করার প্রয়োজন ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হন মুন্সিগঞ্জের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রায়হান কবির। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বেচাকেনা করেন তিনি। ব্যবসার কাজে নারায়ণগঞ্জ এসেছিলেন, একই উদ্দেশে যাবেন ঢাকায়। মাসের অন্তত বিশদিন তার এই যাতায়াত চলে।

শহরের এক নম্বর গেইটের বাসস্ট্যান্ডে টিকেট কাটার সময় কথা হয় তার সাথে। ‘রেল সার্ভিস’ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ করেন তিনি। তারপরও সময় ও অর্থ সাশ্রয়ে যাতায়াতের জন্য ট্রেনকেই সর্বপ্রথম বেছে নেন বলে জানান এই ব্যবসায়ী।

“পরিবহন সিন্ডিকেটকে ব্যবসা দেওয়ার জন্য সারাদেশেই ট্রেন সার্ভিসের বারোটা বাজিয়ে রাখা হয়েছে। বসার সিট ঠিক থাকে না, সিডিউলের ঠিক নাই। তারপরও মানুষ টাকা সাশ্রয়ের জন্য ট্রেনকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু এইটাকেই পুজি করে নেয় অনেকে। এইযে দেখেন, ট্রেন মাসের পর মাস বন্ধ থাকবে, যেন কোন দায় নেই তাদের। বিকল্প কোন ব্যবস্থা তারা রাখেনি। তার উপরে ট্রেন চলাচল যে বন্ধ সেই প্রচারণাটাও তারা ঠিকমতো চালায় না। ট্রেনে ঢাকা যেতে লাগে ১৫ টাকা আর সেই পথই বাসে যেতে লাগতেছে ৫৫ টাকা। এইটাই সিস্টেম চলতেছে।”

নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার কামরুল ইসলাম খান জানান, নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনটি অনেক পুরোনো। ব্রিটিশ আমলে বাণিজ্যের সুবিধার্থে এটি চালু হলেও গত কয়েকদশক যাত্রী পরিবহনেও বেশ উপযোগী এই রেলপথটি। আগে দৈনিক ১৬ জোড়া ট্রেন চলাচল করলেও করোনা পরিস্থিতির সময় এই সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। গত শনিবার পর্যন্তও এই রুটে দশজোড়া ট্রেন চলাচল করেছে।

“নারায়ণগঞ্জ স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনটি চাষাঢ়া, ফতুল্লা, পাগলা, শ্যামপুর, গেন্ডারিয়া স্টেশনগুলোতে থেমে কমলাপুর গিয়ে পৌঁছায়। নারায়ণগঞ্জ স্টেশন থেকে কেবল ঢাকার যাবার পথেই দৈনিক অন্তত দশ হাজার টিকেট বিক্রি হয়। সবগুলো স্টেশন মিলিয়ে বিশ হাজারেরও বেশি মানুষের যাতায়াত হয় রোজ।”

কবে নাগাদ রেল চলাচল পুনরায় চালু হবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি স্টেশন মাস্টার কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “নির্দিষ্ট করে কবে নাগাদ ট্রেন চলাচল আবার চালু হবে তা হেড অফিস থেকে জানানো হয়নি। তবে পদ্মা সেতুর রেলপ্রকল্পের কাজ ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ডাবল রেল লাইন নির্মাণকাজ মিলিয়ে তিন থেকে সাড়ে তিনমাস তো লাগবেই। ততদিন পর্যন্ত বন্ধ থাকারই সম্ভবনা। এই সময়ের মধ্যে যাত্রীদের কিছুটা ভোগান্তি তো পোহাতে হবেই। তবে দ্রুততার সঙ্গে কাজ শেষ করে পুনরায় ট্রেন চলাচল চালু করা যাবে বলে মনে করি।”

এদিকে দীর্ঘ সময় এই রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে উদ্বেগ জানিয়েছে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম। কোন বিলম্ব না করে দ্রুততার সাথে প্রকল্পকাজ শেষ করে ব্যস্ততম এই রেলপথটি দ্রুত চালু করে দেওয়ার দাবি জানান সংগঠনের নেতারা।

ফোরামের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, ‘রেল কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তে আমরা উদ্বিগ্ন। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে প্রতিদিন প্রায় চল্লিশ হাজারের অধিক মানুষ যাতায়াত করেন। বাসের ভাড়া বৃদ্ধির ফলে ট্রেনকেই সাধারণ মানুষ এখন যাতায়াতের প্রধান বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আজকে মানুষের জীবন-জীবিকা যখন চরম সংকটে, তখন রেল কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত মানুষের সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। আমরা দেশে রেল সেবার আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন চাই। কিন্তু জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে সাড়ে তিন মাসের পরিবর্তে আরও কম সময়ে কাজ সম্পন্ন করার জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।”

“আমরা চাই না দেশে অন্যান্য প্রকল্পের মতো এই কাজটি বিলম্বিত হোক। শুরুতেই সে দিকে সতর্ক থাকার জন্য আমরা রেল কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি আহ্বান জানাচ্ছি।”

নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন ও চাষাঢ়া স্টেশনের পাশেই বাসস্ট্যান্ড। ট্রেন বন্ধ থাকলেও বাসগুলোতে যাত্রীদের আলাদা চাপ ছিল না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি ঢাকার গুলিস্তান যায় উৎসব ও বন্ধন পরিবহনের বাস। উভয় পরিবহনের বাস কাউন্টারে কথা বলে জানা যায়, এই দুই পরিবহনে অন্তত দশ হাজার যাত্রী নিয়মিত ঢাকা যাতায়াত করেন। ট্রেন বন্ধ থাকলেও যাত্রীদের আলাদা চাপ ছিল না।

উৎসবের কাউন্টারে বসা মো. হাসান বলেন, “ট্রেন বন্ধ থাকলেও অতিরিক্ত টিকেট বিক্রি হয়নি। প্রথমদিন দেখে হয়তো তেমন চাপ নাই। কিন্তু কয়েকদিন পরও যখন ট্রেন বন্ধ থাকবো তখন হয়তো চাপ বাড়বো।”

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়