২৬ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২২:০৫, ৭ জুন ২০১৮

আপডেট: ০০:৪৭, ৮ জুন ২০১৮

৬৬’র ৭ জুন জেলা আ’লীগের সামনে সমবেত হয় সকল নেতাকর্মী

৬৬’র ৭ জুন জেলা আ’লীগের সামনে সমবেত হয় সকল নেতাকর্মী

প্রেস নারায়ণগঞ্জ: ১৯৬৬ সালের ৭ জুন। আওয়ামী লীগ ৬ দফা দিবস পালনের আহ্বান জানায়। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা এ দিবসের কর্মসূচিকে সাফল্যমন্ডিত করতে প্রস্তুতি নেয়। ঐদিন সারাদেশে ধর্মঘটও ঘোষনা করা হয়। সকল প্রকার যানবাহন বন্ধ রাখার আহ্বান জানানো হয়। এ দিবসে প্রস্তুতি লগ্নে প্রথমে শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি মুস্তাফা সারওয়ার তার মাসদাইরস্থ বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার হন। এ গ্রেপ্তারের সংবাদ পেয়ে অন্যান্য নেতারাও গা ঢাকা দিতে বাধ্য হন। মহিউদ্দিন খোকা ও ঢাকা আওয়ামী লীগের সম্পাদক বজলুর রহমানের বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।

তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি পুলিশ বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলে মহিউদ্দিন খোকা ও বজলুর রহমান পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করেন। তাদেরকে বছরাধিক কাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকতে হয়। এর মধ্যে অল্প সময়ের জন্য মাত্র খোকা মহিউদ্দিন সাহেব ‘প্যারোলে’ মুক্তি পান।

২ নম্বর গেটস্থ আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ এবং যুবলীগের কর্মীরা সমবেত হয়। গোদনাইল শিল্প এলাকা থেকে হাজার হাজার শ্রমিক মিছিল নিয়ে এখানে এসে সমবেত হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট মিছিল এসেও আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে বিশাল জনতার সমাবেশ ঘটে। শেখ মুজিবের মুক্তি ও হরতাল পালনের শ্লোগানসহ বিরাট মিছিল নিযে মহর প্রদক্ষিন করে পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ শুরু করলে জনতাও রুখে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে পুলিশ খাজা মহিউদ্দিন , আবু গফুর এবং রিয়াজুর ইসলাম মিলকিকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়।

খাজা মহিউদ্দিন প্রমুখ গ্রেপ্তার হওয়ায় জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং নারায়ণগঞ্জ থানা গেরাও করে। ফলে শুরু হয়ে যায় জনতা ও পুলিশের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সশস্ত্র পুলিশ তানা থেকে বেরিয়ে এস প্রথমে ফাঁকা আওয়াজ করে। বিক্ষোভকারিদের লক্ষ করে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসতে থাকে।

বেপরোয়া জনতা গুলির জবাবে পুলিশের দিকে ইট পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। থানা থেকে ফকিরটোলা মসজিদ পর্যন্ত যাযগাটুকু রণক্ষেত্রে পরিনত হয়। ২ নং রেলগেটে অবস্থানরত পুলিশের গুলিতে নিহত একজনের মাথার মগজ ছিটকে ফকিরটোলা মসজিদের সুউচ্চ মিনারে গিয়ে পড়ে।

পুলিশের প্রচন্ড গুলিবর্ষনের পলে এক নম্বর রেলগেট থেকে দুই নম্বর মধ্যবর্তী চেম্বার রোডে পর পর ছয়টি প্রান লুটিয়ে পড়ে। আহত হয় অনেকে। এই সময় ক্রুদ্ধ জনগনের ঢিলের আঘাতে মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ আহমদ সহ বহু সংখ্যক পুলিশ আহত হয়। দুপুরের দিকে নিহতদের লাশ নিয়ে (শহীদ কালীপদ ঘোষ, মামসুল হক, রজিবুল্লাহ, বাবুল) বিরাট এক শোক মিছিল বের হয় এক পর্যায়ে মিছিলকারীদের মধ্যে কিছু সংখ্যক কায়েদে আজম রোডস্থ মুসলিম লীগ নেতা চিফ হুইপ এম এ জাহেরের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এখানে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর গুলিবর্ষন করলে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং আরেকজন নিহত হয়।

৭ জুন নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। পত্রিকায় প্রকাশ-

ঢাকা ৭ জুন-আওয়ামী লীগ কতৃক আহূত হরতাল ৭. ৬. ১৯৬৬ তারিখে অতি প্রত্যুষ হইতে পথচারী ও যানবাহনের ব্যাপক বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে সংঘটিত করা হয়। ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে বিভিন্ন এলাকায় ছোকরা ও গুন্ডাদের লেলিয়ে দেওয়া হয়। ই পি আর টি সি বাসগুলিতে ইট পাটকেল ছোড়া হয় এবং টায়ারের পাম্প ছাড়িয়ে দিয়া সর্বপ্রকার যানবাহনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। নিরীহ জনসাধারন ও অফিস অপমান ও হয়রানী করা হয়। হাইকোর্টের সম্মুখে তিনটি গাড়ি পোড়াইয়া দেয়া হয়। পুলিশের কার্জন হল, বাহাদুর শাহ পার্ক ও কাওরান বাজারের নিকট গুন্ডাদের বাধা দান করে এবং টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করিয়া তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয়।

তেজগাঁয় দুই-ডাউন চট্টগ্রাম মেইল তেজগাঁও রেল স্টেশনের আইটার সিগন্যালে আটক করিয়া লাইনচ্যুত করা হয়। ট্রেনখানা প্রহরা দানের জন্য একদল পুলিশ দ্রুত তথায় গমন করে। জনতা তাদের ঘিরিয়া ফেলে এবং তুমুলভাবে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে, ফলে বহু পুলিশ কর্মচারি আহত হয়। যখন পুলিশ জনতার কবলে পড়িয়া যাইবার উপক্রম হয় তখন আত্মরক্ষার জন্য তাহারা গুলিবর্ষন করে। ফলে ৪ ব্যক্তির মৃত্যু হয়।

নারায়ণগঞ্জের এক উচ্ছৃঙ্খল জনতা সকাল ৬-৩০ মিনিটের সময় গলাচিপা রেলওয়ে ক্রসিং এর নিকট ঢাকাগামী ট্রেন আটক করে। পরে জনতা নারায়ণগঞ্জগামী ৩৪নং ডাউন ট্রেন আটকাইয়া উহার বিপুল ক্ষতি সাধন ও ড্রাইভারকে প্রহার করে। জনতা জোর করিয়া যাত্রীদের নামাইয়া দেয়। যাত্রীদের উদ্ধারের জন্য আগত পুলিশ দল আক্রান্ত ও বহু সংখ্যক পুলিশ কর্মচারি আহত হন। পুলিশ দল লাঠি চার্জের সাহায্যে জনতা ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয়। অতঃপর বন্দুকসহ মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে এক জনতা নারায়ণগঞ্জ থানা আক্রমন করিয়া দারুন ক্ষতিসাধন এবং বন্দুকের গুলিতে পুলিশ অফিসারদের জখম করে। উচ্ছৃঙ্খল জনতা থানা ভবনে প্রবেশ করার পর পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলিবর্ষন করার ফলে ৬ ব্যক্তি নিহত ও আরো ১৩ ব্যক্তি আহত হয়। ৪৫ জন পুলিশ আহত হয়। ৪৫ জন পুলিশ আহত হন এবং তাহাদের মধ্যে কয়েকজন আঘাত গুরুতর। ...টঙ্গীতে বিভিন্ন মিলের শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করে এবং একটি মিছিল বাহির করে। .... ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেনীর ছাত্র পিকেটিং করে এবং এখানে আংশিক ধর্মঘট পালিত হয়।

দুপুরে আদমজী, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ডেমরা এলাকার শ্রমিকগন ১৪৪ ধারা লংঘন করিয়া শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হইতে থাকে। ঢাকা নগরীর দুই মাইল দূরে ই. পি. আর বাহিনীর একটি দল শোভাযাত্রার গতিরোধ করে। অপরাহ্নে এক জনতা গেন্ডারিয়ার নিকট একখানি ট্রেন আটক করে, চট্টগ্রামগামী গ্রীন এ্যরো ও ঢাকা অভিমুখী ৩৩ আপ ট্রেনখানিকে অপরাহ্নের দিকে তেজগাঁও স্টেশনে আটক করা হয়। ...সন্ধার পর একটি উচ্ছৃঙ্খল জনতা কালেক্টরেট ও পরে স্টেট ব্যাংক আক্রমন করে। রক্ষীগন জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলিবর্ষন করে।

বেলা ১১ টায় ৫ বা ততোধিক ব্যক্তির একত্র সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করিয়া ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শহরের অন্যান্য স্থানে পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক ছিল।

আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করার প্রয়াসে শত শত পুলিশ নারায়ণগঞ্জ ও ফতুল্লা থানার নাগবাড়ি ঘেরাও করে। গোপনসূত্রে তারা জানতে পারে এখানে ছাত্রলীগের কর্মীদের গোপন বৈঠক হবে। কিন্তু পুলিশের এই অভিযান ব্যর্থ হয়ে যায়। কর্মীরা কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিয়ে অন্যত্র সরে থাকেন।

১৯৬৬ সালে শহর আওয়ামী লীগের মতো মহকুমা আওয়ামী লীগেও পরিবর্তন ঘটে। মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এডভোকেট ফজলুর রহমান এবং বজলুর রহমান পি.ডি.পি.তে যোগ দেয়ায় তার স্থানে আওয়ামী লীগের পুরোনো কমিটির সদস্য এবং ছয় দফার একনিষ্ঠ সমর্থক আনসার আলী সম্পাদক নিযুক্ত হন।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার গোদনাইল ইউনিয়নের কমিউনিস্ট নেতা আব্দুল খালেদ মোল্লা ৬ দফাকে সমর্থন করার জন্য গোদনাইর শিল্প এলাকার শ্রমিকদের নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও নেতৃত্ব দেন জ্ঞান চক্রবর্তী (ঢাকা জেলা কমিউনিস্চ পার্টির সেক্রেটারি), জিতেন ঘোষ, সুনিল রায়, রথীন চক্রবর্তী। গোদনাইল শিল্প এলাকায় এই আন্দোলন ব্যপকভাবে সারা দেয়। শ্রমিকরা তাদের ডাকে ৬ দফাকে সমর্থন করে।

ডা. সাদাত আলী সিকদারের নেতৃত্বে আড়াইহাজারবাসী ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে অংশ নেয়। আওয়ামী লীগের অন্যান্য কর্মীরা ৬ দফাকে ফলপ্রসূ করার জন্য বাঙালি জাতীয়তা বোধের চেতনা, পশ্চিম পাকিস্তানিরা এদেশ শোষন করছে-এই বোধ জনসাধারনের মনে জাগিয়ে তোলে।

১৯৬৬ সালের ৬ দফার আন্দোলন সফল করার জন্য মুড়াপাড়া মাঠে মিছিল সভা হয়। এর নেতৃত্ব দেন সিরাজুদ্দিন ভুঁইয়া।

সোনারগাঁয়ের সুলতানউদ্দিন মোল্লা (বাদশা), মো. লুৎফর রহমান ভঁইয়া ৬ দফার আন্দোলনকে সার্থক করার জন্য ৬ দফার বইটি জনগনের মাঝে প্রচার ও বিক্রি জন্য আওয়ামী লীগের কর্মী হয়ে কাজ করেন। এজন্য তাঁদের সামরিক সরকারে রোষানলে পড়তে হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতিত হন। ৬ দফার বই বিক্রির অপরাধে মুসলিম লীগের কর্মীরা সুলতানউদ্দিন মোল্লা (বাদশা)-কে নারায়নগঞ্জ (কালীবাজার) এলাকায় মেরে রাস্তার পাশে ড্রেনে ফেলে দেয়। আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে ঐ অবস্থায় দেখা মাত্র ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়