২৬ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ০০:২৬, ২ সেপ্টেম্বর ২০২২

আপডেট: ০০:২৭, ২ সেপ্টেম্বর ২০২২

‘আমার পুতের তো গুলি খাইয়া মরার কথা না’

‘আমার পুতের তো গুলি খাইয়া মরার কথা না’

সৌরভ হোসেন সিয়াম (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): “সকালে রাইন্ধা-বাইড়া খাওয়াইয়া দিসি। কামের লাইগা বাইর হইছিল। এহোন শুনি গুলি খাইছে। আমার পুতে জানি কয়বার মা কইয়া ডাকছে। আমার পুতে জানি কেমন করতেছে। তোমরা কেউ আমারে নিতেছো না ক্যান? পুতেরে আইনা দেও বুকে নিমু।”

বাড়ির সামনে উঠানে পা ছড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ফরিদা বেগম। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তার ছোট ছেলে শাওন প্রধান (২০) নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিআইটিতে বিএনপি ও পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে পাগলপ্রায় ফরিদা। একনাগারে কেঁদে যাচ্ছেন।

নিহত শাওন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার এনায়েতনগর ও বক্তাবলী ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী পূর্ব গোপালনগর এলাকার মৃত সাহেব আলীর ছেলে। নবীনগর শাহ্ওয়ার আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে শাওনদের একতলা বাড়ি।

চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে শাওন সবার ছোট। বছর দুয়েক পূর্বে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বড় মেয়ে হেনা। তার একমাস পর মানসিক ভারসাম্যহীন বড় ছেলে লিটন গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারা যান। পরপর দুই সন্তানের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠলেও ছোটছেলের এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না ফরিদা বেগম। তাকে বারবার সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন পাশে বসে থাকা বোন জমিলা বেগম। প্রতিবেশীরাও নানাভাবে সান্তনা দিচ্ছেন তাকে। কিছুতেই মানছেন তা ফরিদা।

চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “আল্লায় নিলে নাইলে মানা যাইতো। আল্লায় তো নিলো না। আমার পুতের তো গুলি খাইয়া মরার কথা না।”

এমন সময় শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ঢোকেন ফরিদার আরেক মেয়ে শিল্পী। ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে কেরানীগঞ্জের জাজিরা থেকে ছুটে এসেছেন তিনি। মাকে উঠানে কাঁদতে দেখে একছুটে তার বুকে লুটিয়ে পড়েন শিল্পী। মা ও মেয়ের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে আশেপাশের বাতাস।

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শাওনের। বাড়ির অদূরে একটি ইজিবাইক তৈরির কারখানায় কাজ করতো সে। গত তিনমাস যাবৎ এই কারখানায় কাজ করেন শাওন। প্রতিদিন সকাল নয়টায় কারখানায় আসার কথা থাকলেও আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে আসেননি বলে জানান একই কারখানার শাওনের সহকর্মী মো. হাবিবউল্লাহ। তিনি বলেন, “ওয়েল্ডিং শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো শাওন। প্রতিদিন সকাল নয়টার দিকে কাজে আসার কথা। আজকে আসে নাই। শুনছি শহরে বিএনপির মিছিলে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে সে।”

প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতা-কর্মীরা সকাল দশটায় নগরীর ডিআইটিতে আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনের সামনে থেকে শোভাযাত্রা বের করার প্রস্তুতি নেয়। এতে পুলিশ বাধা দিলে নেতা-কর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। বেলা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত দফায় দফায় চলে এই সংঘর্ষ। এই সময় গুলিবিদ্ধ হয় শাওন।

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শাওনকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন কয়েকজন। তাদের মধ্যে একজন নিজেকে দেওভোগের বাবুরাইল এলাকার বাসিন্দা ও বিএনপির কর্মী বলে পরিচয় দেন। তিনি নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন জানিয়ে ডান পায়ে গুলির আঘাত দেখান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি (২৮) বলেন, “ওর (শাওন) লগে আরও লোক আছিল। আমরাও ছিলাম। তয় ওরে আমরা চিনতাম না। ওয় অন্য গ্রæপের লগে আইছে। পুলিশ যখন গুলি করতেছিল তখন আমরা গুলশান হলের গেটের সামনে ছিলাম। দুইপাশ দিয়াই ইট-পাটকেল মারতাছিল অনেকে। ওই পোলায় একটা ইট হাতে নিয়া রাস্তায় নামার পরই একটা গুলি আইসা তার বুকে লাগে। নিচে পইড়া গেলে তারে তুইলা গুলশান হলের গেটের সামনে আইনা রাখি। পরে ওয় কয়, ‘ভাই আমারে হাসপাতালে নিয়া যান, আমার ভাল্লাগতাছে না’। হাসপাতালে আসার পর ডাক্তার কইছে ওয় মারা গেছে।”

এদিকে শাওনের মৃত্যুর পরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিএনপির একটি মিছিলের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। ওই মিছিলের অগ্রভাগে ডোরাকাটা টি-শার্ট ও কালো রঙের জিন্স প্যান্ট পরা অবস্থায় শাওনকে দেখা যায়। হাসপাতালে শাওনের মরদেহেও একই টি-শার্ট ও জিন্স প্যান্ট রয়েছে।

যদিও শাওন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয় বলে দাবি করেছে তার পরিবারের লোকজন। শাওনের বড়ভাই ফরহাদ প্রধান বলেন, “আমার ভাই কোন রাজনীতির সাথে যুক্ত না। স্থানীয় যুবদলের কয়েকজন নেতার ডাকে শাওন মিছিলে যায়। দুপুর বারোটার দিকে জানতে পারি গুলিবিদ্ধ হইয়া শাওন হাসপাতালে।”

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে নিহত শাওন ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বক্তাবলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত আলীর ভাতিজা। তিনি বলেন, “শাওনের বাবা সাহেব আলী আমার আপন চাচাতো ভাই ছিল। সেই হিসেবে শাওন আমার ভাতিজা। শাওনের বড়ভাই মিলন আমার সাথেই থাকে। আমি নিজে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। তবে ওরা ভাইরা সরাসরি কোন দল করে না। ডাক দিলে আমার লগেও যায়, আবার অন্য কেউ ডাক দিলেও যায়। এলাকার কারও ডাকে শহরে বিএনপির মিছিলে গেল কিনা সেই বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত না।”

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়