২৬ এপ্রিল ২০২৪

প্রকাশিত: ২১:২৪, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

আপডেট: ২১:৩০, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নামে পাঠাগারের মাঠ দখলের অভিযোগ

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নামে পাঠাগারের মাঠ দখলের অভিযোগ

প্রেস নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার তল্লা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নামে ‘সাধারণ পাঠাগার, নারায়ণগঞ্জ’ নামে সুপরিচিত একটি পাঠাগারের মাঠ দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের এক সাবেক কাউন্সিলরের নেতৃত্বে স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জমি দখলে সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ পাঠাগারের কর্মকর্তাদের। স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এই কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকলেও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের নেতারা ‘কাজটি ভালো হচ্ছে না’ বলে মন্তব্য করেছেন।

সাধারণ পাঠাগারের কর্মকর্তারা জানান, তিন দশক আগে ১৯৯০ সালে পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত এই পাঠাগারের উপদেষ্টা শেখ মোজাম্মেল হকের নামে লিজ থাকা রেলওয়ের ১৮ শতাংশ জমির ৩ শতাংশের উপর আধাপাকা ভবন নির্মাণ করা হয়। ভবনের সামনের খালি জায়গায় এলাকার শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করে এবং পাঠাগারের বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম চলে। শিশু-কিশোরদের এই খেলাধুলার জায়গাটি দখল করে বাঁশের খুটি গেঁথে টিনের বেষ্টনি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাঠাগার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।

তাদের অভিযোগ, পাঠাগারের জমি দখলে নিতে কাজ করছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও স্থানীয় বিএনপি নেতা জমশের আলী ঝন্টু। স্থানীয়ভাবে বেশ প্রভাবশালী সাবেক এই জনপ্রতিনিধি তার লোকজনকে নিয়ে পাঠাগারের জমি দখলে নিয়েছেন। তাকে সহযোগিতা করছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মাহি, আলী নূর, মো. আলাউদ্দিন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নামে সাইনবোর্ড সাটিয়ে শিশু-কিশোরদের বিকাশে ভূমিকা রাখা সাধারণ পাঠাগারের সামনের খেলার মাঠটি দখলে নিতে চান তারা।

শনিবার বেলা একটার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, খোলা পাঠাগারে বসে আছে তিন শিশু। বই হাতে পাতা ওল্টাছে তারা। পাঠাগারে বড় কেউ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনজন সমস্বরে বলে ওঠে, ‘আমাদের মাঠ নিয়া যাইতেছে। এইখানে কেউ নাই।’

পরে কথা হয় সাধারণ পাঠাগারের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভাপতি মঈন আহসানের সাথে। তিনি বলেন, ‘সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে প্রগতিশীল সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে সাধারণ পাঠাগার, নারায়ণগঞ্জ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালনের পাশাপাশি, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের অবৈতনিক পাঠদানও দিয়ে আসছি আমরা। এছাড়া বিগত সময়ে বিভিন্ন দুর্যোগে ত্রাণসামগ্রী বিতরণও করা হয়েছে। এমনকি ইপিআই টিকাদান কর্মসূচিও এই পাঠাগারে চলে। স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় এই পাঠাগারের কার্যক্রম চলে। এই পাঠাগারে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, অধ্যক্ষ হামিদা আলী, ড. করুণাময় গোস্বামীসহ বিভিন্নজন এই পাঠাগারে এসেছেন। এই পাঠাগারে দাবা প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম অর্জন করেছেন।’

‘পাঠাগারের সামনে খালি জায়গা রাখা হয়েছে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা ও পাঠাগারের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য। এই জায়গাটি দখলের জন্য এর আগেও অনেকেই চেষ্টা করে পাঠাগারের লোকজন ও এলাকাবাসীর বাধায় ব্যর্থ হয়েছেন। সম্প্রতি এই জমিটি দখলের জন্য চেষ্টা করছেন সাবেক কাউন্সিলর জমশের আলী ঝন্টু। তিনি তার ছেলে শাহাদাত হোসেন বাবু ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে শনিবার বেলা ১১টায় পাঠাগারের মাঠটিতে বাঁশের খুটি গেঁথে টিনের বেড়া দিয়েছেন।’

মঈন আহসান বলেন, ‘তাদের অনেক বোঝানোর পরও কেউ কথা শোনেননি। পাঠাগারের ৫ শতাংশ জমি তারা দখলে নিচ্ছেন। এইটা করলে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা ও পাঠাগারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার আর জায়গা থাকবে না। আমরা এই বিষয়ে জেলা প্রশাসন, স্থানীয় সাংসদ ও মেয়রকে জানাবো। আশা করবো, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ভূমিকা রাখা এই পাঠাগারের মাঠটিকে শিশু-কিশোরদের বিকাশের জন্য অরক্ষিত রাখতে তারা ব্যবস্থা নেবেন।’

সরেজমিনে দেখা যায়, পাঠাগারের মাঠের উপর বাঁশের খুটি গেথে টিনের বেষ্টনি দেওয়ার কাজ করছেন কয়েকজন তরুণ। সামনে বড় আকারে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ’ লেখা একটি সাইনবোর্ড সাটানো। পাশে রাস্তার উপর চেয়ারে বসে আছেন সাবেক কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি জমশের আলী ঝন্টু। তার পাশেই বসে ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী নূর। পাঠাগারের মাঠে বেষ্টনি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘এইটা রেলওয়ের জমি। পাঠাগারের নামে আগে লিজ থাকলেও, এখন এইটা কারও লিজে নাই। মুক্তিযোদ্ধারা বসার জন্য একটা অফিস এখানে করবে। সেইটার জন্য বেড়া দেওয়া হচ্ছে।’

স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এই কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকলেও স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার অ্যাডভোকেট নুরুল হুদা ‘কাজটি ভালো হচ্ছে না’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানরা একটা বসার জায়গা চেয়েছিল। আমরা এই বিষয়ে পাঠাগারের সাথে আলাপও করেছিলাম। তখন ১০ বাই ২০ ফুটের একটা বসার জায়গা করার বিষয়ে সকলে সম্মতি দেয়। কিন্তু পরে তারা এইটা না মেনে মাঠটিতে বেষ্টনি দিচ্ছে।

‘মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান আছে, তাই বলে তো কারও জায়গা অবৈধভাবে দখলে নিতে পারি না। তাছাড়া সরকারিভাবে আমাদের জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স আছে। ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ে কমপ্লেক্স করার তো কোন অনুমতি নাই। এইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে মাঠ দখল করার বিষয়ে আমার কোন সমর্থন নাই। এটা যারা করছেন তারাও ভালো কাজ করছেন না।’

একই কথা বললেন সদর উপজেলা কমান্ডার শাহ্জাহান ভূঁইয়া জুলহাস। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বসার জায়গা দরকার আছে কিন্তু সেটা সমঝোতার মধ্যে হওয়ার কথা। আমি আর হুদা ভাই সকালে গেছিলাম। সমঝোতার মাধ্যমে কাজ করার প্রস্তাব আমরা দিছি। কিন্তু সেখানকার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানরা আমাদের কথা না শোনায় আমরা সেখান থেকে চইলা আসছি।’

এদিকে পাঠাগারের সভাপতি মঈন আহসান বলেন, ‘পাঠাগারের উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য ইউএনও বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাঠাগারের উন্নয়নের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা কর্ণার করারও কথা ছিল। এই বিষয়টা তাদের বলেছিও, কিন্তু তারা সেসব না শুনেই জোর করে মাঠটি দখলে নিয়েছে।’

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এই বিষয়টি শুনেছি, তবে কেউ আমার সাথে এ নিয়ে আলোচনা করেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদা সম্মান আছে। আবার পাঠাগারের মাঠটিও বিবেচনার বিষয়। উভয়পক্ষেরই সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করা উচিত ছিল বলে মনে করি।’

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়